ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি উক্তি বেশ প্রচলিত হয়ে উঠেছে, যা অনেকেই তাদের ওয়ালে শেয়ার করছেন। উক্তিটি হলো, ঈশ্বর যৌনতা সৃষ্টি করেছেন আর যাজকরা সৃষ্টি করেছেন বিবাহ।
এই উক্তিটি বিশেষত তাদের কাছে প্রভাব ফেলেছে যারা অবাধ যৌনতার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে মনে করেন না। তবে এই ধারণাটি কি সত্যিই যুক্তিযুক্ত? আসুন, কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হলো।
উক্তিটির উৎপত্তি ও সত্যতা
ধারণা করা হয়, এই উক্তিটি প্রথমবার এসেছে ফ্রঁসোয়া-মারি আরুয়ের (১৬৯৪-১৭৭৮), যিনি ফরাসি দার্শনিক ও লেখক ভলতেয়ার ছদ্মনামেই নামেই অধিক পরিচিত। উক্তিটি মূলত সমাজে অবাধ যৌনতা ও বিবাহের বিরুদ্ধে এক ধরনের বার্তা হিসেবে প্রচারিত হয়ে থাকে। তবে কুরআন ও হাদিসের আলোকে এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং ভুল ধারণা।
বিবাহের প্রথার প্রাচীনতা
মানব সভ্যতার শুরুর দিনগুলো থেকেই বিবাহ প্রথা বিদ্যমান ছিল। প্রথম মানব, আদম আ.-এর সময় থেকেই এই প্রথার সূচনা হয়েছিল। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আদম আ. ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া আ. একে অপরের জন্য পরিপূরক। সুরা বাকরাহর ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর আমি বললাম, হে আদম তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো এবং তা থেকে আহার করো স্বাচ্ছন্দ্যে, তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী এবং এই গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না, তাহলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
এ আয়াতে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, আদম আ. ও হাওয়া আ. একে অপরের সঙ্গী হিসেবে সৃষ্টি হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা আল্লাহর বিধান অনুসারে ছিল।
আদম আ. ও হাওয়া আ.-এর সম্পর্ক
তাফসিরে উল্লেখ রয়েছে যে, আদম আ. -এর সৃষ্টি হওয়ার পর তাঁর বাঁ পাঁজর থেকে হাওয়া আ. -কে সৃষ্টি করা হয়। ইবনে কাসির রাহ. তাঁর তাফসিরে উল্লেখ করেছেন যে, আদম আ. যখন ঘুমে ছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর শরীর থেকে একটি হাড় নিয়ে সেটির মাধ্যমে হাওয়া আ. -কে সৃষ্টি করেন। পরে, আদম আ. যখন ঘুম থেকে ওঠেন, তিনি হাওয়াকে তাঁর সঙ্গী হিসেবে দেখতে পান এবং তাঁকে স্ত্রী হিসেবে সম্বোধন করেন।
কুরআনে আরও বলা হয়েছে, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। (সুরা নিসা, আয়াত: ১)
এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা প্রথম মানব আদম আ.-কে সৃষ্টি করার পর তাঁর সঙ্গী হিসেবে হাওয়া আ.-কে সৃষ্টি করেছেন, যা বিবাহের প্রাথমিক প্রমাণ।
বিবাহের বিধান ও পদ্ধতি
আলেমরা বলেন, আদম আ. ও হাওয়া আ. -এর সম্পর্ক ছিল আদর্শ বিবাহের সূচনা। তবে, তাঁদের বংশধরদের জন্য এক নতুন বিধানও আরোপ করা হয়েছিল। ইবনে কাসির রহ. তাঁর তাফসিরে উল্লেখ করেছেন যে, আদম আ. -এর সন্তানদের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান ছিল, যেখানে এক গর্ভে জন্ম নেয়া পুত্র ও কন্যাকে সহোদর হিসেবেই গণ্য করা হয়েছিল, এবং তাদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। তবে, পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া পুত্র ও কন্যার মধ্যে বিবাহ বৈধ ছিল। (ইবনে কাসির)
উক্তির ভুল ব্যাখ্যা
যারা বলেন, ঈশ্বর যৌনতা সৃষ্টি করেছেন আর যাজকরা সৃষ্টি করেছেন বিবাহ, তারা ভুলভাবে বুঝে থাকেন যে, বিবাহ একটি মানবিক সৃষ্ট কৃতিত্ব, যা সমাজে কিছু লোক (যাজকরা) প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ কুরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বিবাহ একটি মহান বিধান, যা আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। মানব সমাজের প্রথম দিক থেকেই বিবাহের প্রথা ছিল এবং এটি সমাজে একটি সুশৃঙ্খল সম্পর্ক বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সুতরাং, উক্তিটি সম্পূর্ণ মনগড়া এবং বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। কুরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, বিবাহ একটি আল্লাহর দেয়া বিধান, যা মানুষের সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে অপরিহার্য। তাই এই ধরনের মনগড়া উক্তি বিশ্বাস করা কিংবা প্রচার করা ভুল।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই ধরনের ভুল মতাদর্শ থেকে বেচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।