মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া বাজার এলাকায় চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) গভীর রাতে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা এই হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মানবেন্দ্রের পরিবার। আগুনে তার বাড়ির একটি কক্ষ সম্পূর্ণভাবে পুড়ে গেছে।
পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষ একটি শোভামণ্ডপের শিল্পনির্মাণে অংশ নেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দাবি করা হয়, সেখানে প্রদর্শিত একটি শিল্পকর্মে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখাকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যদিও মানবেন্দ্র এই দাবি সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, “আমি শেখ হাসিনার কোনো মুখাকৃতি তৈরি করিনি, আমি বাঘের মোটিফ নির্মাণ করেছি, যেটি বৈশাখী শোভাযাত্রার ঐতিহ্যবাহী উপাদান।”
এই বিতর্কের পর মঙ্গলবার রাতে দুর্বৃত্তরা মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। আগুনে ঘরে থাকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম, বইপত্র এবং আসবাবপত্র পুড়ে যায়। ঘটনার সময় পরিবারের সদস্যরা বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন, তবে ভাগ্যক্রমে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এ বিষয়ে বুধবার (১৬ এপ্রিল) নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে মানবেন্দ্র ঘোষ লিখেছেন, “আমাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।” এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মানবেন্দ্র বলেন, “আমি ও আমার পরিবার এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাদের বিরুদ্ধে যেভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তাতে যেকোনো মুহূর্তে আরও বড় হামলার আশঙ্কা রয়েছে। আমি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি, যাতে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় এবং দোষীদের খুঁজে বের করা হয়।”
ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মানিকগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমান উল্লাহ। তিনি জানান, “ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।” ওসি আরও বলেন, “এখন পর্যন্ত কেউ এই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি, তবে আমরা সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য সংগ্রহ করছি।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়ি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বাসার খুব কাছেই, একই এলাকার মধ্যে অবস্থিত। এলাকাবাসীর অনেকেই ধারণা করছেন, রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই শোভাযাত্রার একটি উপাদানকে কেন্দ্র করে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে এই হামলা চালানো হয়ে থাকতে পারে।
প্রসঙ্গত, মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত একটি বাঙালি নববর্ষ উদযাপনের অংশ, যেখানে প্রতীকী ভাস্কর্য ও মুখোশের মাধ্যমে সামাজিক-রাজনৈতিক বার্তা তুলে ধরা হয়। এবারের শোভাযাত্রায় মানবেন্দ্র ঘোষের সহকর্মী এবং শিক্ষার্থীদের তৈরি একটি শোভামণ্ডপ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর আলোচনা সৃষ্টি হয়, যেখানে কিছু রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা অভিযোগ তোলে—শেখ হাসিনার ব্যঙ্গচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে শিল্পীর নিরাপত্তা, শিল্পের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা—এই তিনটি ইস্যু আবারও জনমনে প্রশ্ন তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই লিখেছেন, “শিল্পের ব্যাখ্যা যদি ভুল হয়, তাহলে দায় কি কল্পনার ওপর পড়ে?” কেউ কেউ আবার এটিকে সুশৃঙ্খল দমননীতির অংশ বলেও উল্লেখ করেছেন।
সরকারি পর্যায় থেকে এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এই অগ্নিসংযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে মানবাধিকার সংগঠন এবং শিল্পমহলের প্রতিনিধিরা দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন উঠছে—একজন শিল্পীর কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতা যদি রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার হয়, তাহলে সে সমাজ কতটা নিরাপদ, কতটা সহনশীল? মানবেন্দ্র ঘোষের ঘটনায় সেই প্রশ্ন আরও একবার সামনে উঠে এসেছে।

সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা পরিকল্পিত বলে সন্দেহ করছেন অনেকে। আপনি কী মনে করেন?