ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর রাজনৈতিক উত্তেজনার করাল ছায়ায় অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন নিষ্ঠুর বাস্তবতার। এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্তে, যেখানে ৯ মাসের শিশু আজলানকে নিয়ে এসেছিলেন তার মা সায়রা ও বাবা ফারহান।
কিন্তু পাসপোর্টের রঙ হয়ে উঠল বিভাজনের প্রতীক, আর একটি পরিবার ভেঙে গেল কাঁটাতারের এপারে-ওপারে।
নয়াদিল্লির বাসিন্দা ফারহান ও করাচির সায়রার ভালোবাসার শুরু হয়েছিল ফেসবুকে। ভালোবাসা থেকে বিয়ে, তারপর সায়রার ভারতে এসে বসবাস। কিন্তু সীমান্তের রাজনীতির সামনে ব্যক্তিগত ভালোবাসা কতটা অসহায়, তার প্রমাণ রাখল এই ঘটনা।
কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ফলে সায়রাকে বাধ্য হয়ে ফিরতে হয় পাকিস্তানে, কিন্তু আজলানকে সঙ্গে নিতে দেওয়া হয়নি, কারণ তার পাসপোর্ট ছিল ভারতীয়।
সীমান্তে দাঁড়িয়ে সায়রা ও ফারহান একে অপরকে শক্ত করে ধরে ছিলেন। তাঁরা ভাবতেও পারেননি যে তাঁদের সন্তানকেও আলাদা করে নেওয়া হবে। যখন নিরাপত্তারক্ষী বললেন, ‘বাচ্চাটি যাবে না, ম্যাডাম’, তখন সায়রার সব আশা ভেঙে পড়ে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের জোর করে আলাদা করে দেওয়া হয়। মা গেলেন করাচির পথে, আর ছেলে ফিরে এল বাবার কোলে নয়াদিল্লিতে।
এই শুধু সায়রার গল্প নয়। হালিমা বেগমের মতো আরও অনেকেই এ নিষ্ঠুর বাস্তবতার শিকার। ২৫ বছর ধরে ভারতে বসবাস করা হালিমাকে হঠাৎ করে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, যদিও তাঁর দুই ছেলে ভারতীয়। একজন মা হিসেবে সন্তানদের রেখে চলে যাওয়ার যন্ত্রণায় কাতর হালিমা, জানেন না করাচিতে গিয়ে কোথায় থাকবেন, কেমন করে বাঁচবেন।
এইসব বাস্তব কাহিনিগুলো ‘নির্বাসনের জীবনের’ প্রতিচ্ছবি। সুচিত্রা বিজয়নের লেখা Midnight’s Borders বইয়েও এমন বহু গল্প উঠে এসেছে, যেখানে দেখা যায়—সীমান্ত কেবল দুটি ভূখণ্ডকে ভাগ করে না, ভেঙে ফেলে পরিবার, ভালোবাসা, সম্পর্ক, এমনকি জীবনের অর্থও। সুচিত্রা বলেন, বিশেষ করে যারা বিয়ে সূত্রে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেছেন, তাদের জীবনে বিভাজনের প্রভাব সবচেয়ে গভীর।
সীমান্তে দাঁড়িয়ে সন্তানকে কোলে নিয়ে ফারহান হয়তো ভেবেছিলেন, কর্তৃপক্ষ কিছুটা মানবিকতা দেখাবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল নির্মম। তিনি বলেন, ‘সায়রাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার আগে জীবন কতটাই না আলাদা ছিল।’ তার বোন নুরিন বলেন, ‘শুধু একজন মা-ই জানেন, তাঁর ৯ মাসের সন্তানকে ফেলে আসার কষ্ট কী।’
এই ঘটনাগুলো শুধু কিছু মানুষের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং দুই দেশের বৈরিতা কিভাবে সাধারণ মানুষের জীবনকে রক্তাক্ত করে, তার প্রতিচ্ছবি। ফারহানের মা আয়েশা বেগম বলেন, ‘ইয়ে সব পেয়ার কে মরে হ্যায়।’ তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে শত শত পারিবারিক ভাঙনের ইতিহাস।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন রয়ে যায়—রাজনীতির এই নিষ্ঠুর খেলা কবে থামবে? মানুষ কবে আবার ভালোবাসা ও মানবতার জয় দেখতে পাবে? আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, সীমান্তের দুই পাশে থাকা পরিবারগুলো আজও এক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয়কে ধরে এনেছে গ্রামবাসী। এব্যাপারে আপনার মতামত কি?