ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাত হচ্ছে এমন এক সময়, যখন দেশ দু’টির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘স্পর্শকাতর’ অবস্থায় রয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন রয়েছে। আর দীর্ঘ সময় পর পাকিস্তানের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করছে বাংলাদেশ। ফলে কোনো দিকে ঝুঁকে পড়লে, সেটা বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক হবে।
অন্যদিকে, সঙ্ঘাত যদি প্রলম্বিত হয় এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব বেশি হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে?
নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য-বিবৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে থাকা প্রয়োজন। কোনো পক্ষের প্রতি সমর্থন প্রকাশ পেলে, তা অন্য পক্ষের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম যে প্রতিক্রিয়া এসেছে, তাতে অবশ্য সতর্ক অবস্থানই প্রকাশ পেয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান, দু’দেশকেই সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। একইসাথে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কূটনৈতিকভাবে উত্তেজনার অবসান হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে ঢাকা।
দেশ দু’টির সাথে সম্পর্কের বিষয় ছাড়াও বাংলাদেশের আমদানি-রফতানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আকাশপথে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে, সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তুতি কী আছে-এ প্রশ্নও রয়েছে বিশ্লেষকদের।
‘বাংলাদেশের সতর্ক অবস্থান নেয়া প্রয়োজন’
বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। শুরু থেকেই এ সরকারের সাথে ভারত সরকারের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নয় মাসেও সেই টানাপোড়েন কমার কোনো ইঙ্গিত নেই।
তবে দেড় দশকেরও বেশি সময় পর পাকিস্তানের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় সাবেক কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা দেশ দু’টির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে ‘স্পর্শকাতর অবস্থায়’ বলে উল্লেখ করছেন।
তারা বলছেন, এখন দু’দেশের সঙ্ঘাতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যদি পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে ভারতের সাথে এ সরকারের সম্পর্কে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
আবার ভারতের দিকে ঝুঁকলেও সমস্যা পড়তে হবে বাংলাদেশকে। কারণ এর প্রভাব পড়তে পারে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতবিরোধী শক্তিগুলোর প্রভাব বেড়েছে; তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে। তাদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
এমন বাস্তবতার কথা উল্লেখ করে বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত-পাকিস্তানের এই সঙ্ঘাতে বাংলাদেশের সতর্ক ও নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়া প্রয়োজন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামানের পাশাপাশি চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়ার কথা বলছেন।
তারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক অবস্থানে থেকে কৌশল ঠিক করতে হবে।
অতীতেও বিভিন্ন সময় ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারগুলো সতর্ক ও কূটনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করেছে।
এমনকি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনের সময়ও যখন ২০১৯ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা, সঙ্ঘাত হয়েছিল, বাংলাদেশের সেই সরকারও সতর্ক ও নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছিল বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতিতে নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক বলছেন, তারা পরিস্থিতির প্রভাব ও বাস্তবতা সম্পর্কে সতর্ক থেকেই প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
কী বলতে চাইছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একইসাথে বাংলাদেশ দু’দেশকেই সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বুধবার বলেছেন, উভয়পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ মনে করে কূটনৈতিক দিক থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত।
তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিরসন করে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থানে ফিরে আসবে বলে বাংলাদেশ আশা করে।
বুধবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো একটি বিবৃতিও দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ।
‘সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উভয় দেশকে বাংলাদেশ অনুরোধ করেছে যেন তারা শান্ত থাকে, ধৈর্য প্রদর্শন করে এবং পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে, এমন পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকে।’
‘বাংলাদেশ আশা করছে, আঞ্চলিক শান্তি, উন্নতি এবং স্থিতিশীলতার জন্য কূটনৈতিকভাবে এই উত্তেজনার অবসান হবে,’ বলা হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ভারত, পাকিস্তানের এই সঙ্ঘাতে বাংলাদেশে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।
এরপরও বংলাদেশের পণ্য আমদানি-রফতানিতে ভারতের আকাশপথে কোনো সমস্যা হয় কি না, সেটা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের জন্য প্রভাব বেশি হবে কেন
ভারত-পাকিস্তানের যে অঞ্চলে সঙ্ঘাত হচ্ছে, সেই অঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত নেই। ফলে বাংলাদেশের জন্য এই সঙ্ঘাতের সরাসরি কোনো প্রভাব দেখছেন না বিশ্লেষকদের অনেকে।
তবে সঙ্ঘাত যদি প্রলম্বিত হয় এবং পরিস্থিতি যুদ্ধে রূপ নেয়, তখন দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা প্রশ্নে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, বিশ্লেষকেরা এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন।
আর অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ওপরই প্রভাব বেশি পড়বে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেনারেল মুনীরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারতের সীমান্ত। সেটি নিরাপত্তার দিক থেকে একটি বড় বিষয়।
এছাড়া আকাশপথে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে হয়। এই বাণিজ্য এবং যাত্রীবাহী বিমান চলাচলেও প্রভাব পড়বে। আকাশপথ নিরাপত্তার প্রশ্নে বিকল্প রুট ব্যবহার করতে হবে।
ইতোমধ্যে বুধবার ঢাকামুখী ও ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া কয়েকট ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার না করে ভিন্ন রুটে চলাচল করেছে। এতে এসব ফ্লাইটের গন্তব্যে পৌঁছুতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, একদিকে আকাশপথে চলাচলে সময় বেশি প্রয়োজন হবে, অন্যদিকে আমদানি-রপতানিতে ব্যয় বাড়বে। তখন পণ্যের দাম বাড়বে এবং এর প্রভাব পড়বে ভাক্তা পর্যায়ে।
এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে চাপে পড়তে পারে বলেও বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন একটা বিষয় তুলে ধরছেন।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের সাথে ভারতের সাতটি অঙ্গরাজ্য আছে। সেগুলোতে যদি ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাতের কোনো প্রভাব পড়ে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন এর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদশে। ফলে নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগের বিষয় এখানে রয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে বাাংলাদেশের প্রস্তুতি রাখাা প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
সঙ্ঘাতের প্রভাবের প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিবৃতি যে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি ভারত পাকস্তানের সঙ্ঘাত যাত না বাড়ে, সেজন্য দু’দেশকেই সংযত হতে বলা হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বাংলাদেশের এই বক্তব্যকে ‘রুটিন’ বিবৃতি হিসেবে দেখছেন। তাদের কথায়, সাধারণত কূটনৈতিক দিক থেকে এ ধরনের বিবৃতি দেয়া হয়।
কিন্তু পরিস্থিতির প্রভাব সামলাতে কী প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বা কৌশল কী হচ্ছে- সেটা বলেনি বাংলাদেশ সরকার।
যদিও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, আমদানি, রফতানি ও আকাশপথে চলাচলে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং একটা প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি

দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয়কে ধরে এনেছে গ্রামবাসী। এব্যাপারে আপনার মতামত কি?