স্বপ্ন মানুষের অবচেতন মনের এক গভীর প্রকাশ, যা অনেক সময় আমাদের কৌতূহল সৃষ্টি করে। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বপ্নের তাৎপর্য রয়েছে এবং মুমিনদের স্বপ্ন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মহানবী সা. বলেছেন, মুমিনের স্বপ্ন সত্য হতে পারে, তবে কিছু স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকেও হতে পারে। তাই, স্বপ্নের মধ্যে ভালো-মন্দের পার্থক্য জানা গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমরা জানবো কার স্বপ্ন বেশি সত্য হয় এবং কোন সময়ের স্বপ্ন সত্য হয়, ইনশাআল্লাহ।
স্বপ্ন তাৎপর্যহীন নয়
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের স্বপ্ন তাৎপর্যহীন নয়, বরং মুমিনের স্বপ্ন বিশেষ গুরুত্ব রাখে। রসুলুল্লাহ সা. সত্য স্বপ্নকে নবুয়তের অংশ বলেছেন। আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, কেবল মুবাশশিরাত (সুসংবাদ) ছাড়া নবুয়তের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সাহাবিরা প্রশ্ন করেন, মুবাশশিরাত কী? তিনি বলেন, ভালো স্বপ্ন। (বুখারি শরিফ, হাদিস: ৬৯৯০) অন্য হাদিসে বিশ্বনবী সা. বলেন, মুমিনের স্বপ্ন নবুওতের ৪৬ ভাগের এক ভাগের সমান। (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস: ৫০১৮)
যাদের স্বপ্ন সত্য হয়
নবী-রাসুলদের স্বপ্ন ছিল সন্দেহাতীতভাবে সত্য। তাঁদের স্বপ্ন ছিল ওহি। সহিহ বুখারির বর্ণনা মতে, নবীজির ওপর স্বপ্ন সত্যের মাধ্যমেই তাঁর ওপর ওহি নাজিলের সূচনা হয়েছিল। আর উম্মতের মধ্যে তাদের স্বপ্নই বেশি সত্য হয়, যারা কথা ও কাজে অধিক সত্যবাদী। নবী করিম সা. বলেছেন, সময় যখন কাছাকাছি হবে তখন মুসলিমের স্বপ্ন মিথ্যা হবে না এবং যে যত সত্যবাদী হবে তার স্বপ্নও তত সত্য হবে। স্বপ্ন তিন প্রকার: ১. উত্তম স্বপ্ন, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ, ২. ভীতিপ্রদ স্বপ্ন, যা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, ৩. যা মানুষ চিন্তা-ভাবনা ও ধারণা অনুপাতে দেখে থাকে। (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস: ৫০১৯)
যে সময়ের স্বপ্ন সত্য হয়
দিন ও রাতের যেকোনো সময়ের স্বপ্ন সত্য হতে পারে। কোনো সময়কে সত্য স্বপ্নের জন্য নির্ধারণ করা হয়নি। তবে রাতের স্বপ্ন দিনের স্বপ্নের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সিরিন রহ. বলেছেন, দিনের স্বপ্ন রাতের স্বপ্নের মতো হয়। ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উভয়ের বিধান এক। পুরুষ ও নারীর স্বপ্নের মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই। (তাফসিরুল আহলাম মিন কালামি আইম্মাতিল আলাম, পৃষ্ঠা-৯৩)
তবে মহানবী সা. এমন কিছু সময় উল্লেখ করেছেন, যেসব সময়ের স্বপ্ন অধিক সত্য হয়।
১. যখন দিন-রাতের পরিধি সমান হয়: যখন দিন ও রাতের ব্যাপ্তি সময় বা কাছাকাছি হয়, তখন মুমিনের স্বপ্ন সত্য হয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, সময় যখন কাছাকাছি হবে তখন মুসলিমের স্বপ্ন মিথ্যা হবে না। (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস: ৫০১৯) ইমাম বাগাভি রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, বসন্ত ও শরৎকালের স্বপ্ন অধিক সত্য হয়। যখন গাছে ফল আসে ও তা পরিপক্ব হয়, তখন সময় নিকটবর্তী থাকে এবং দিন-রাতের পরিধি সমান থাকে। (তাজিলুস সুকয়া ফি তাবিরির রুয়া, পৃষ্ঠা-১৩)
২. শেষ রাতের স্বপ্ন: প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, রাতের শেষ অর্ধাংশের স্বপ্ন বেশি সত্য হয়, চাই তা ফজরের আগে হোক বা পরে। কেননা এ সময় মহান আল্লাহ পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেন এবং এটা ফেরেশতাদের ছড়িয়ে পড়ার সময়। আর প্রথম অর্ধাংশের স্বপ্ন বেশির ভাগ সময় মিথ্যা হয়, কেননা এটি শয়তানের বিচরণ করার সময়। (তাজিলুস সুকয়া ফি তাবিরির রুয়া, পৃষ্ঠা-১৩) এ বিষয়ে বিশ্বনবী সা. বলেছেন, শেষ রাতের স্বপ্ন অধিক সত্য হয়। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২২৭৪)
৩. কিয়ামতের পূর্ববর্তী সময়: কিয়ামতের পূর্বে মুমিনের স্বপ্ন অধিক পরিমাণে সত্য হবে। মহানবী সা. বলেছেন, যখন কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হবে, তখন মুমিনের স্বপ্ন খুব কমই মিথ্যা হবে। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২২৭০) এর কারণ ব্যাখ্যায় আল্লামা সিন্ধি রহ. বলেন, কিয়ামত হলো সেই সত্য প্রকাশকারী, যা সব সত্য প্রমাণ করবে। সুতরাং যে জিনিস তার যত বেশি নিকটবর্তী হবে তা তত বেশি বাস্তব হবে। (মুসনাদে আহমদ (টীকা): ১৩/৮২)
যে সময়ের স্বপ্ন দ্রুত প্রতিফলিত হয়
আল্লামা দিনওয়ারি রহ. বলেন, প্রথম রাতের স্বপ্ন বিলম্বে বাস্তবায়িত হয়, রাতের অন্য অংশের তুলনায় শেষ অর্ধাংশের স্বপ্ন দ্রুত প্রতিফলিত হয়। সবচেয়ে দ্রুত প্রতিফলিত হয় সাহরির (শেষ রাত) সময়ের স্বপ্ন, বিশেষ করে ফজর উদিত হওয়ার সময়। (ফাতহুল বারি: ১৬/৩৩৯)
স্বপ্নের ব্যাপারে মহানবী সা.-এর হুঁশিয়ারি
আবু রাজিন উকাইলি রা. বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, স্বপ্নের ব্যাপারে যে পর্যন্ত আলোচনা করা না হয়, সে পর্যন্ত এটা পাখির পায়ে (ঝুলে) থাকা জিনিসের মতো। আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে তা যেন পা থেকে পড়ে গেল। তাই স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যক্তি যেন জ্ঞানী ব্যক্তি অথবা পছন্দীয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো কাছে স্বপ্নের ব্যাপারে আলোচনা না করে।(তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২২৭৮)
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে স্বপ্নের তাৎপর্য বুঝে, তা সঠিকভাবে গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করা এবং ভালো স্বপ্নে আল্লাহর প্রশংসা করা ও খারাপ স্বপ্নে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।