মিরাজ, ইসলামের এক অতুলনীয় ও অলৌকিক ঘটনা, যেখানে রসুলুল্লাহ সা. আল্লাহর নির্দেশে আসমান ও জমিনের সীমানা পেরিয়ে এক মহান সফরে গমন করেন। এই সফরে তিনি সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত, জাহান্নাম এবং আল্লাহর বিশেষ রহমত ও উপহারসমূহ প্রত্যক্ষ করেন। মিরাজের এই ঘটনা মুসলমানদের জন্য একটি অতুলনীয় শিক্ষা এবং বিশ্বাসের শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে অবস্থান করে। এতে নবী সা.-এর উম্মতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অমূল্য উপহার দেওয়া হয়েছে, যা পরবর্তী জীবনে আমাদের কর্ম ও আচরণকে সঠিক পথ দেখায়।
সিদরাতুল মুনতাহা
নবী কারীম সা.-কে নিয়ে যাওয়া হল সিদরাতুল মুনতাহার দিকে। সেই কুল বৃক্ষের একেকটি পাতা হাতির কানের মতো। আর একেকটি ফল মটকার মতো বড় বড়। যখন ওটাকে আল্লাহর বিধান আচ্ছন্ন করে নিল তা পরিবর্তিত হয়ে গেল। সৃষ্টির কারো সাধ্য নেই তার সৌন্দর্যের বিবরণ দেবার। জিবরীল বললেন, এটা সিদরাতুল মুনতাহা। এখানে চারটি নহর। দুটি অদৃশ্য আর দুটি দৃশ্যমান। নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন, দৃশ্যমান নদী দুটি কোনগুলো? জিবরীল বললেন, অদৃশ্যমান দুটি জান্নাতে। আর দৃশ্যমান দুটি হল নীল নদ ও ফুরাত নদী।
এরপর আল্লাহ তায়ালা নবী সা.-এর প্রতি যে ওহি পাঠানোর পাঠালেন। দিনরাতে উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দিলেন। নবী কারীম সা. আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাতের এ হাদিয়া নিয়ে ফেরত আসছিলেন; এরই মধ্যে দেখা হজরত মুসা আ.-এর সাথে। হজরত মুসা আ. জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ আপনার উম্মতের জন্য কী দিয়েছেন? নবী কারীম সা. বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ। হজরত মুসা বললেন, আপনার উম্মত রাত-দিনে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারবে না। আপনি আল্লাহর কাছে গিয়ে কমিয়ে আনেন।
নবী সা. সে মতে আল্লাহর কাছে গিয়ে কম করে দেওয়ার দরখাস্ত করলেন। আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। নবী সা. তা নিয়ে ফেরত আসছিলেন। আবার হজরত মুসা আ.-এর সাথে দেখা হল। বললেন, আপনার উম্মত তা পারবে না। আপনি আরো কমিয়ে আনুন। নবীজি আবার আল্লাহর কাছে গিয়ে আগের মতো দরখাস্ত করে আরো পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে আনলেন। নবী সা. বলেন, এভাবে আমি আল্লাহ ও মুসার মাঝে আসা-যাওয়া করতে থাকি। শেষবার আল্লাহ বলেন, মুহাম্মাদ! এই হল দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
প্রত্যেক নামাযের বিনিময়ে দশ নামাযের সাওয়াব। এভাবে বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সওয়াব পাবে। কেউ কোনো ভালো কাজের ইচ্ছা করবে কিন্তু করতে পারবে না, তার জন্যও নেকী রয়েছে। এক নেকী। আর যদি ভালো কাজটি করে তাহলে তার জন্য দশ নেকী। আর কেউ কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করলে কোনো গুনাহ লেখা হবে না। তবে তা করে বসলে একটি গুনাহ লেখা হবে।
নবী সা. এ সওগাত নিয়ে ফেরত আসছিলেন। হজরত মুসার সাথে দেখা হল। মুসা আ. এবার শুনে বললেন, আপনি যান, আরো কমিয়ে আনুন। আপনার উম্মত পারবে না। বনী ইসরায়েলের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। নবী কারীম সা. বললেন, আমার আর কিছু বলতে লজ্জা হচ্ছে! ( বুখারি শরিফ, হাদিস ৩৮৮৭; মুসলিম শরিফ, হাদিস: ১৬২-১৬৪)
এ সফরে নবী কারীম সা. জান্নাত-জাহান্নামের ভ্রমণও করানো হয়। নবীজী বলেন, জান্নাতের প্রাসাদগুলো মুক্তার তৈরি আর তার মাটি হল মেশকের। ( বুখারি শরিফ, হাদিস: ৭৫১৭)
নবী সা. এ সফরে একদল লোককে দেখলেন, তাদের নখগুলো তামার। নিজেদের নখ দিয়ে তারা নিজের গাল ও বুকে আঁচড় কাটছে। জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাইল, এরা কারা? বললেন, এরা ওই সমস্ত লোক, যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের সম্ভ্রমে আঘাত হানত। অর্থাৎ গিবত করত এবং মানুষকে লাঞ্ছিত করত। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১৩৩৪০; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৮৭৮)
মিরাজ থেকে ফিরার পর কাফেরদের আচরণ
মিরাজ থেকে ফিরে রসুলুল্লাহ সা. হাতীমে বসে আছেন। মুশরিকরা ইসরা ও মেরাজের ঘটনা শুনে উপহাস ও কটাক্ষ করতে লাগল। বিভিন্নভাবে নবীর দিকে প্রশ্নের তীর ছুড়তে লাগল। তারা চাইল, বাইতুল মাকদিসের পূর্ণ বিবরণ শুনবে। নবী সা. এমন প্রশ্নে খুবই বিব্রত হয়ে ওঠেন। এতো রাতে কি বাইতুল মাকদিস ওরকম নিখুঁতভাবে দেখতে গিয়েছেন নাকি! নবী কারীম সা. বলেন, এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমি আগে পড়িনি।
এখানেও ঘটলো আরেক মুজিযার ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে সাহায্য করলেন। তিনি নবী সা.-এর চোখের সামনে মেলে ধরলেন বাইতুল মাকদিসের পূর্ণ দৃশ্য। নবী সা. দেখে দেখে তাদের প্রত্যেকটি প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব দিলেন। সুবহানাল্লাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৮৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৭২)
এসফরে অর্জিত বিশেষ তিনটি উপহার
এ সফরে নবী সা. ও উম্মতে মুহাম্মাদিকে তিনটি উপহার দেওয়া হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামায, সুরা বাকারার শেষ আয়াতগুলো এবং এই উম্মতের যারা শিরক থেকে বেঁচে থেকে মৃত্যুবরণ করবে তাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়ার ঘোষণা।(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৩)
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ইসলামের এই অতুলনীয় ও অলৌকিক ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন । আমিন ।
লেখক: মুফতি মুখলিছুর রহমান
মুদাররিস: জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলুম কুষ্টিয়া