নবী কারীম সা.-এর বরকতময় জীবনরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হলো ইসরা ও মিরাজ। এ ঘটনাটি ঘটেছিল নবী কারিম সা.-এর হিজরতের পূর্বে। আর তা ছিল নবী কারিম সা.-এর রিসালাতের অনেক বড় মুজিযা; যা অন্য কোনো নবীকে দেয়া হয়নি। আবার এটি ছিল এই উম্মতের জন্য অনেক বড় নিয়ামত।
এই ঘটনায় একদিকে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও নির্দেশনা, অন্যদিকে সেখানে লুকিয়ে রয়েছে আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য হিকমত ও রহস্য। তাই প্রত্যেক ইমানদারের উচিত ইসরা ও মিরাজের সঠিক ঘটনাটি জানা এবং এ সম্পর্কে সঠিক আকিদা পোষণ করা।
বস্তুত ইসরা হচ্ছে, মক্কা মুকাররমা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণের সেই পর্বটুকু, যা রাতের একটি অংশে সংঘটিত হয়েছিল। আর মিরাজ হচ্ছে সেখান থেকে ঊর্ধ্বজগৎ পরিভ্রমণের সেই বিস্তৃত অধ্যায়। মনে রাখতে হবে, রসুল সা.-এর মিরাজ হয়েছিল স্বশরীরে; স্বাপ্নিক নয়।
কুরআনের আলোকে
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সুরা বানী ইসরাঈল-এর শুরুতেই ইরশাদ করেছেন, পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতের একটি অংশে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু শোনেন এবং সব কিছু জানেন। (সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত: ১)
আর সুরা নাজম-এ ইরশাদ হয়েছে, বস্তুত সে তাকে (হজরত জিবরাইল আ.-কে) আরও একবার দেখেছে। সিদরাতুল মুনতাহা (সীমান্তবতীর কুলগাছ)-এর কাছে। তারই কাছে অবস্থিত জান্নাতুল মা’ওয়া। তখন সেই কুল গাছটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেই জিনিস, যা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। রসুলের চোখ বিভ্রান্ত হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি।
অর্থাৎ দেখার ব্যাপারে চোখ ধোঁকায় পড়েনি এবং আল্লাহ তায়ালা তার জন্য যে সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, তিনি তা লংঘনও করেননি যে, তার সামনে কী আছে তা দেখতে যাবে।) বাস্তবিকপক্ষে, সে তার প্রতিপালকের বড় বড় নিদর্শনের মধ্য হতে বহু কিছু দেখেছে। (সূরা নাজম, আয়াত: ১৩-১৮)
ইসরা ও মিরাজের ব্যাপারে কুরআনের বর্ণনায় সংক্ষেপে এতটুকুই বলা হয়েছে। আর এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে হাদিস শরিফে। সিরাত ও তারিখের নির্ভরযোগ্য সূত্রেও রয়েছে এর বিশদ বিবরণ।
হাদিসের আলোকে
মক্কায় অবস্থানকালে কোনো একরাতে রসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদের নিয়ে ইশার নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর খানায়ে কাবা সংলগ্ন ‘হাতীমে’ শুয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। তিনি ছিলেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। তখনও নিদ্রা আসেনি। কলব বা অন্তর ছিল জাগ্রত। এরই মাঝে আগমন করলেন হজরত জিবরাইল আ.। তিনি নবীজীকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন যমযমের নিকট।
একটি স্বর্ণের পেয়ালা আনা হল। তা ছিল ইমান ও হিকমতে পূর্ণ। তাতে যমযমের পানি। জিবরাইল আ. নবীজীর বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করলেন। বের করে আনলেন নবীজীর হৃৎপিণ্ড। যমযমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে দিলেন। ইমান ও হিকমতে পূর্ণ করে দেওয়া হল নবীজীর কলব।
এরপর আনা হল নবীজীকে বহন করার জন্য একটি বুরাক। এই প্রাণীটি ছিল গাধার চেয়ে বড়, ঘোড়া থেকে ছোট। রং সাদা। এটা এতটাই ক্ষিপ্রগতির যে, যার একেকটি কদম পড়ে দৃষ্টির শেষ সীমায় গিয়ে। তার পিঠের উপর জিন আঁটা ছিল, মুখে ছিল লাগাম। নবীজী রেকাবে পা রাখবেন এমন সময় ‘বুরাক’ ঔদ্ধত্য দেখাল।
জিবরীল আ. তাকে থামিয়ে বললেন, হে বুরাক! তুমি মুহাম্মাদ সা.-এর সামনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছ? তুমি কি জান, আল্লাহর কাছে তার চেয়ে মহান ও প্রিয়তম কোনো ব্যক্তি কখনও তোমার উপর সওয়ার হয়নি। একথা শুনতেই বুরাক ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। (সুনানে তিরমিযী, হাদিস: ৩১৩১)
অতঃপর নবীজি সা. বুরাকে আরোহণ করলেন। মুহূর্তেই এসে উপস্থিত হলেন জেরুজালেম নগরীর বায়তুল মাকদিসে। হজরত জিবরীল আ. পাথর ছিদ্র করে বুরাকটি বেঁধে রাখলেন। এই পাথরেই নবীগণ নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন।
বায়তুল মাকদিসে ঢুকে তিনি দেখেন, হজরত মূসা আ. নামাযরত আছেন। হজরত ঈসা আ.-কেও দণ্ডায়মান হয়ে নামাজ পড়তে দেখা গেল। হজরত ইবরাহীম আ.-কেও নামাযরত অবস্থায় দৃষ্টিগোচর হল। নবীজী বলেন, তাঁর দেহাবয়ব আমার সাথে অধিক সামঞ্জ্যশীল। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৭)
ইতিমধ্যে জামাত প্রস্তুত হল। তিনি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। সকল নবী-রসুলগণ নবীজীর পিছনে ইক্তেদা করলেন। ওখান থেকে বের হয়েই দেখলেন, জিবরীল আ.-এর হাতে দুটি সুদৃশ্য পাত্র। একটি শরাবের, অপরটি দুধের । পাত্র দুটি পেশ করা হলে নবীজি দুধেরটিকেই বেছে নিলেন।
এটা দেখে জিবরীল আ. তাঁকে বললেন, আপনি ও আপনার উম্মত স্বভাবজাত ফিত্রাতকেই বেছে নিয়েছেন। আপনি যদি তা পছন্দ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩৯৪ / সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৮)
এরপর শুরু হল ঊর্ধ্বজগতের সফর। হজরত জিবরাইল নবীজিকে নিয়ে চললেন। একেক করে সপ্ত আসমান পারি দিলেন। তখন প্রত্যেক প্রত্যেক আসমানেই পূর্ববর্তী নবীগণের সাথে সাক্ষাৎ হয়।
ইসরা ও মিরাজ ছিল মুসলমানদের জন্য এক অমূল্য শিক্ষার দিক। এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মত আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও হিকমত সম্পর্কে আরো জানতে পারে। এটি শুধু নবী সা.-এর জন্য একটি বিশেষ মুজিযা ছিল না, বরং উম্মতের জন্যও একটি বড় নিয়ামত, যা আমাদের ইমান ও আস্থা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: মুফতি মুখলিছুর রহমান
মুদাররিস: জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলুম কুষ্টিয়া