গাজায় যখন চলতি শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় চলছে, ঠিক তখনই সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মদিনার নিকটস্থ পর্যটন শহর আল-উলায় আয়োজিত একটি ডিজে পার্টি ঘিরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে দেশটি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, শত শত তরুণ-তরুণী পশ্চিমা স্টাইলে ডিজে সাউন্ডে উদ্দাম নাচ-গানে মেতে উঠেছেন। অনেকেই আরব ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত অবস্থায়ও পার্টিতে অংশ নিচ্ছেন। ভিডিওগুলোতে দাবি করা হয়েছে, এগুলোর বেশিরভাগই আল-উলার বিখ্যাত এলিফ্যান্ট রক এলাকাজুড়ে ধারণ করা হয়েছে, যা মদিনা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় ব্যাপক নিন্দা ও ক্ষোভের ঝড়। ব্যবহারকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন—যখন গাজার মানুষেরা এক টুকরো রুটির জন্য কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটছেন, শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধ নারীরা পর্যন্ত জীবন বাঁচাতে লড়ছেন, তখন মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশে এমন বিলাসী আয়োজন কতটা সংবেদনশীল ও যুক্তিযুক্ত?
গাজা পরিস্থিতি বর্তমানে ভয়াবহ। সেখানে বারবারের বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ, ইসরায়েলি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করছে, যার ফলে দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যু বেড়েই চলেছে। এক ফিলিস্তিনি নারী মিডিয়াকে বলেন, “পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষের মতো আমরাও মানুষ। রাজপ্রাসাদ চাই না, শুধু একটু খাবার চাই ক্ষুধা মেটানোর জন্য।”
এই বাস্তবতার মধ্যে সৌদি আরবের এমন উৎসব আয়োজন অনেকের কাছে অমানবিক ও বেমানান মনে হচ্ছে। অনেক মুসলিম নাগরিক সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন, “পবিত্র মক্কা-মদিনার দেশে যখন মুসলিম ভাইবোনেরা ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে, তখন এমন উৎসব কতটা ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?”
এ নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)। তার নেতৃত্বেই দেশটিতে ব্যাপক সামাজিক সংস্কার চলছে, যার মধ্যে রয়েছে সিনেমা হল চালু, নারীদের গাড়ি চালনার অনুমতি, আন্তর্জাতিক কনসার্ট, মিক্সড ইভেন্টসহ নানা সংস্কার। তবে এসব পরিবর্তন মুসলিম বিশ্বের অনেক অংশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষ করে গাজা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এমন আয়োজনকে অনেকে “সময় ও বাস্তবতার প্রতি চরম অশ্রদ্ধা” বলেই উল্লেখ করছেন। কেবল সৌদি আরব নয়, কাতারের লুসাইল ফেস্টিভাল—যেখানে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রঙিন এয়ার শো ও উন্মুক্ত কনসার্ট আয়োজন করা হয়েছে—তাও একইভাবে বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে।
সমালোচকরা বলছেন, আরব নেতৃত্ব এখন মানবিক সংকটের সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। গাজায় চলমান সংকটকে কেন্দ্র করে যখন জাতিগত নিধন, যুদ্ধাপরাধ ও খাদ্য অবরোধের মতো ইস্যুতে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ হচ্ছে, তখন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর এই উদাসীনতা ইসলামি সংহতি ও নৈতিক নেতৃত্বের প্রশ্ন তুলছে।
সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে সামাজিক মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কিছু অংশ সংস্কারকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও, আন্তর্জাতিক পরিসরে সৌদি নেতৃত্বের মানবিক ও ধর্মীয় সংহতির প্রশ্নে অবস্থান দিন দিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব এখন দ্বিধার দ্বন্দ্বে রয়েছে—একদিকে উদার সংস্কারের পথে পশ্চিমা মডেলের অনুসরণ, অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় ও মানবিক নেতৃত্বের ঐতিহাসিক দাবি। গাজা সংকট সেই দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এবং ডিজে পার্টির মতো ঘটনা কেবল সেই আস্থার ফাটলকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

জয় ও নিঝুম মজুমদারের এই আহ্বানকে দেশবিরোধী বলে মনে করেন ?