কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি ও চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই আজ সোমবার ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের দুই পররাষ্ট্র সচিব বৈঠকে বসছেন। সকাল ১০টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি নিজ নিজ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। পরে যমুনায় বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করবেন বিক্রম মিশ্রি। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুদেশের মধ্যে এটিই উচ্চ পর্যায়ের প্রথম বৈঠক।
আর সম্মিলিত সনাতন জাগরণী মঞ্চের মুখপাত্র ও সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার যেন সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। তাই দুই পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনায় সাম্প্রতিক নানা ইস্যু উঠে আসার পাশাপাশি তা সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে এরই মধ্যে নিশ্চিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর ঘটনাপ্রবাহ দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, তাতে এই বৈঠকে কী আলোচনা হয় এবং এখান থেকে নতুন কোনো দিকে পরিস্থিতি মোড় নেয় কি না, তা নিয়ে আগ্রহ আছে মানুষের।
সফরে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি, রাজনৈতিক বোঝাপড়া, ভারতীয় গণমাধ্যমের বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার, ভারতে বসে শেখ হাসিনার বক্তব্য, ভিসার জট খোলা, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, ভারত থেকে নিত্যপণ্য আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে রপ্তানির নানা বাধা সরানোসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হতে পারে। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠক থেকে বড় কিছু অর্জনের সুযোগ না থাকলেও, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই দেশ বৈঠক বা আলোচনায় বসেছে—এটাই হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
জানা যায়, পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এ বৈঠকে আলোচনার জন্য প্রাথমিক এজেন্ডা ঠিক করে থাকে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো। আবার আলোচনার সময় অনেক ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিষয়ও উঠে আসে। তবে ঠিক কি নিয়ে আলোচনা হবে, সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত এজেন্ডা প্রকাশ করেনি কোনো পক্ষই। কর্মকর্তারা যে ধারণা দিচ্ছেন তা হলো, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের যে কোনো বৈঠকে কয়েকটি বিষয়টি নিয়মিত আলোচনায় আসে।
বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন কিংবা বিশেষভাবে তিস্তাসহ কিছু নদীর পানির বিষয়টি উল্লেখ করে থাকে। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা ও সীমান্ত পরিস্থিতিও গুরুত্ব পায়। পাশাপাশি সাম্প্রতিক ইস্যুগুলো এবার বেশি প্রাধান্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম বলেছেন, দুই দেশের মধ্যকার ‘কমন বিষয়’গুলোই আলোচনায় আসবে। সীমান্ত, বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, পানির মতো অনেক বিষয় দুই দেশের আলোচনায় সাধারণভাবে থাকে। তবে এজেন্ডায় শেষ পর্যন্ত কী থাকবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট উইং কাজ করছে।
অন্যদিকে সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূতরা বলছেন, রাজনৈতিক ইস্যুতে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিক্ততার জায়গা নেই। তাই সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক সচল পর্যায়ে নিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন দুই সচিব।
সরকার পতনের পর শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং সংখ্যালঘু ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও ভারতের নাম উল্লেখ করে নানা মন্তব্য করেছেন, যা ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভারতবিরোধী প্রচার লক্ষ করা যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ব্যাপকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে—ভারতীয় মিডিয়ায় এমন প্রচারেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকারও এ ধরনের খবর সত্য নয় বলে দাবি করেছে।
সর্বশেষ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্যাতনসহ বেশকিছু অভিযোগ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত অতিরঞ্জিত এবং অসত্য খবর ধরে দেশটির সরকার যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ভিসা সংকুচিত করা প্রসঙ্গে এই কূটনীতিক বলেন, অবশ্যই ভিসা নিয়ে আলোচনা হবে। ভিসা অনেকটাই বন্ধ। চিকিৎসাজনিত কারণে অনেকেই ভারতে যান, যা সম্পূর্ণ ইমার্জেন্সি, এখন তা অনেকটাই সীমিত। কীভাবে এটি স্বাভাবিক হয়, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাণিজ্য প্রতি বছরই আলোচনায় আছে। আমদানি আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে করা লাগে। এর বিকল্প এক দিনেই হবে না। আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে যেন আমাদের রপ্তানি করা পণ্য তারা আরও নেয়। এলসিসহ নানা বাধা যেন মোকাবিলা করা যায়, এসব নিয়ে আলোচনা হবে।
ভারত আগেও যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, আশা করি এবারও তা করবে। সবাইকেই মনে রাখতে হবে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে। তাই আমাদের পক্ষ থেকে আমরা স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করব আর ভারত তাদের স্বার্থ দেখবে। আশা করি উভয়ই তাদের সাম্প্রতিক সমস্য বোঝার চেষ্টা করবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, দুদেশের চলমান সংখ্যালঘু পরিস্থিতি, আগরতলা, কলকাতা মিশনে হামলা সংক্রান্ত বিষয়, ভারতের ভিসা কার্যক্রম স্বাভাবিক করা, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আমদানি সহজ করা, পণ্যের শুল্ক কমানো প্রসঙ্গ, সীমান্ত হত্যাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
ঢাকা-দিল্লি পররাষ্ট্র সচিব বৈঠকে গুরুত্ব পাবে সমসাময়িক ইস্যু