পবিত্র রমজান মাসের আগমন মুসলিমদের জন্য অপার আনন্দের বিষয়। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, “বলুন, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। তারা যা সঞ্চয় করে, তা এর চেয়ে উত্তম।” (সূরা ইউনুস: ৫৮)। আল্লাহর এই অনুগ্রহের তুলনা কোনো পার্থিব সম্পদের সঙ্গে হতে পারে না, কারণ এটি অনন্ত কল্যাণের প্রতীক।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও রমজানের আগমনে অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। তিনি সাহাবাদের বলতেন, “তোমাদের দ্বারে বরকতময় মাস রমজান এসেছে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরজ করেছেন। এই মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের বন্দি করা হয়। এই মাসে রয়েছে একটি রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে প্রকৃতপক্ষে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো।” (নাসায়ী, হাদিস নম্বর: ২১০৬)।
রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত
১. সিয়াম ফরজ হওয়ার মাস
রমজান মাস ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ রোজার মাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর একটি হল রমজানের রোজা।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর: ৮)।
২. কুরআন নাজিলের মাস
রমজান কুরআন নাজিলের মাস। আল্লাহ বলেন, “রমজান মাস, এতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য দিশারি, স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৫)।
কুরআন কারিম সপ্তম আকাশের লাওহে মাহফুজ থেকে একসঙ্গে দুনিয়ার আকাশে বায়তুল ইজ্জতে নাজিল করা হয়েছিল, এরপর ধাপে ধাপে রমজান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অবতীর্ণ হতে শুরু করে।
৩. জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন রমজান মাস আসে, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের বন্দি করা হয়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ১০৭৯)।
৪. লাইলাতুল কদরের বরকতময় রাত
আল্লাহ বলেন, “লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ এবং রুহ (জিবরাইল) অবতীর্ণ হন প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক বিষয়ের জন্য। শান্তিই শান্তি, সেই রাত ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত।” (সূরা আল-কদর: ৩-৫)।
৫. রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “রমজান মাসে প্রত্যেক মুসলিমের দোয়া কবুল করা হয়।” (মুসনাদ আহমদ, হাদিস নম্বর: ৭০৮২)।
৬. রমজান পাপ মোচনের মাস
যারা সত্যিকারের খাঁটি অন্তরে ইবাদত করেন, তাদের জন্য এই মাস পাপ থেকে মুক্তির সুযোগ এনে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য) সাথে রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর: ২০১৪)।
৭. জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস
তিনি আরও বলেন, “রমজানের প্রথম রাতে শয়তান ও বিদ্রোহী জিনদের বন্দি করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এ সময় একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেন, ‘হে সৎকর্মপরায়ণ! তুমি অগ্রসর হও! হে পাপাচারী! তুমি বিরত হও!’ প্রতি রাতেই বহু মানুষকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।” (তিরমিজি, হাদিস নম্বর: ৬৮২)।
৮. সৎকাজের প্রতিদান বৃদ্ধি
রমজান মাসে প্রতিটি সৎকর্মের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “রমজানে ওমরাহ করলে তা একটি হজের সমতুল্য।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর: ১৭৮২)।
৯. ধৈর্য ও সবরের মাস
রমজান মাস আমাদের ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায়। আল্লাহ বলেন, “ধৈর্যশীলদের জন্য বিনা হিসেবে পুরস্কার রয়েছে।” (সূরা আজ-জুমার: ১০)।
১০. মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের মাস
এই মাস মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সংহতির শিক্ষা দেয়। একে অপরকে সাহায্য করা, দান-সদকা বাড়ানো, গরিবদের পাশে দাঁড়ানো—এসব কাজ রমজান মাসে আরও বৃদ্ধি পায়।
আমাদের কর্তব্য কী?
রমজান মাসের এই বিশাল নেয়ামত ও ফজিলতকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে আমাদের অবশ্যই সৎকর্মে ব্রতী হতে হবে। যথাযথভাবে রোজা পালন, বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত, তওবা-ইস্তিগফার, তাহাজ্জুদ ও নফল ইবাদতে মনোনিবেশ করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ তার গুনাহ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না, তার জন্য ধ্বংস অনিবার্য।” (তিরমিজি, হাদিস নম্বর: ৩৫৪৫)।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র রমজানের ফজিলত অনুধাবন করে যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।