শাবান মাসের ১৫তম রাত, বা ‘শবে বরাত’, বিশেষ একটি বরকতময় রাত, যা মুসলিমদের জন্য ইবাদত ও তাওবা করার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমত ও দয়া বর্ষণ করেন। তবে, এ রাতের বরকত লাভের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যেগুলো মুমিনের পালন করা উচিত।
১.আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন না করা
আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে শরিক করা থেকে সর্বদা বিরত থাকা। আল্লাহ শিরকের গুনাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। সুরা নিসার ৪৮ নং আয়াতে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে শরিক করে, সে এক মহাপাপ রটনা করে।’
এ সম্পর্কে একাধিক হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘এক ব্যক্তি রসুল সা.কে জিজ্ঞাসা করলো, ইয়া রসুলাল্লাহ! আল্লাহ তায়ালার নিকট সবচেয়ে বড় অপরাধ কোনটি? তিনি উত্তরে বললেন, কাউকে আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ সাব্যস্ত করা অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সহিহ বুখারী, হাদিস : ৬৮৬১; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪২) তাই এ রাতে ক্ষমা লাভের জন্য শিরক থেকে সর্বদা বিরত থাকা।
২.হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা
কারো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ না করা। এ ব্যাপারেও হাদিসে নববীতে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল সা. ইরশাদ করেছেন,‘প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। ফলে যারা আল্লাহ তায়ালার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করে না, এমন প্রত্যেক বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেন। তবে ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয় না, যার মাঝে এবং তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের মাঝে বিদ্বেষ রয়েছে। তখন (ফেরেশতাদেরকে লক্ষ্য করে) বলা হয়, এই দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রে (ক্ষমার ঘোষণা কার্যকর করা থেকে) বিরত থাকো, যতক্ষণ না তারা নিজেদের মাঝে সংশোধন করে নেয়। অনুরূপ কথা তিনবার বলা হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯১৬)
৩. রাত্রি জাগরণ ও নফল ইবাদত করা
এ রাতে যতটুকু সম্ভব একাকী নফল ইবাদত যেমন- যিকির-আযকার করা, দোয়া-দরুদ পড়া, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা, নফল নামাজ পড়া, (সম্ভব হলে দীর্ঘ রুকু-সেজদা করা), তওবা-ইস্তিগফার করা, আল্লাহ তায়ালার কাছে রোনাযারী করা ইত্যাদি আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়া। রসুল সা. নিজেও এ রাতে দীর্ঘ রুকু-সেজদা বিশিষ্ট নফল নামাজ আদায় করাসহ বিভিন্ন নফল ইবাদতে মশগুল থাকতেন। (শুয়াবুল ঈমান (বায় হা কী), হাদিস : ৩৫৫৪)
৪. ইস্তেগফার ও দোয়া করা
ইস্তেগফার হলো, নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর দোয়া হলো, আল্লাহকে ডাকা, নিজ প্রয়োজন পূরণের জন্য তাঁর নিকট প্রার্থনা করা। আর মানুষ সর্বদাই মহান রবের মুখাপেক্ষী। তাই প্রতিনিয়ত তাঁকে ডাকা ও তাঁর নিকট প্রার্থনা করা। সে হিসেবে দোয়া একটি দৈনন্দিন আমল। আর হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী যেহেতু আল্লাহ তায়ালা এ রাতে বান্দার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন, তাই অন্য দিনের তুলনায় এ রাতে আরো বেশি গুরুত্বের সাথে কায়মনোবাক্যে দোয়া করা।
৫. ১৫ই শাবান রোযা রাখা
শবে বরাতের আরেকটি আমল হলো দিনে রোযা রাখা। যদিও সংশ্লিষ্ট হাদিসটি সনদের বিবেচনায় দুর্বল। তথাপি মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ নানা দলিলের আলোকে উক্ত দিনে রোযা রাখা সওয়াব লাভের কারণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হজরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রসুল সা. বলেন, ‘শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও আর দিনের বেলায় রোযা রাখো। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে এসে বলেন, আছে কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছে কি কোনো রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দান করবো। আছে কি কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি? আমি তাকে তা থেকে মুক্তি দান করবো। এভাবে সুবেহ সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে বলে তাদের ডাকতে থাকেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮)
শাবান মাসের ১৫তম রাত আমাদের জন্য বিশেষ রহমত ও ক্ষমা লাভের সুযোগ এনে দেয়। এই রাতের বরকত থেকে লাভবান হতে, আমাদের শিরক ও হিংসা পরিহার করা, নফল ইবাদত করা, ইস্তিগফার ও দোয়া করা এবং রোযা রাখা উচিত। তবে, এ রাতেও কিছু মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়, যারা বিভিন্ন গুরুতর গুনাহে লিপ্ত থাকে। আমাদের উচিত এই রাতের মহিমাকে উপলব্ধি করে, নিজের গুনাহ মাফ করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।
লেখক: মুফতি মুখলিছুর রহমান
মুদাররিস: জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলুম কুষ্টিয়া