নিঃসন্দেহে, পরনিন্দা বা গিবত একটি মহাপাপ, যা কোনো মুসলমানের অজানা নয়। কুরআন ও হাদিসের ভাষায় এ পাপকে ‘গিবত’ বলা হয়, এবং এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে এর শাস্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, গিবত বা পরনিন্দা হলো ‘অপর ভাইয়ের এমন দোষত্রুটি অন্য মানুষের সামনে তুলে ধরা যা সে অপছন্দ করে’, যদিও সেই ত্রুটি তার ভিতরে বিদ্যমান থাকে। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের অনেক সময় ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এমন গিবত হয়ে থাকে, যা আমরা জানতেও পারি না। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা একে অপরের গিবত করবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো এটা ঘৃণা কর। আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত: ১২)
গিবত বা পরনিন্দা এমন একটি পাপ যা গীবতকারী এবং শ্রোতা উভয়কেই তৃপ্তি করে, যার কারণে এই পাপ সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পর্যন্ত এর প্রভাব পড়তে দেখা যায়। অনেক সময় দেখা যায় যে, যিনি পরনিন্দা করেন, তিনি সমাজে জনসমক্ষে আরও জনপ্রিয় হয়ে যান।
গিবতের সামাজিক প্রতিক্রিয়া
গিবত বা পরনিন্দার ফলে সমাজে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এটি কেবল ঐ ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরনিন্দার কারণে সামাজিক বন্ধন ভেঙে পড়ে, সম্পর্কের মধ্যে শত্রুতা তৈরি হয় এবং সমাজের শান্তি বিঘ্নিত হয়। মুসলিম সমাজে এই ধরনের পাপ বিশেষত ধর্মপ্রাণদের মধ্যে বৈরিতার সৃষ্টি করে।
গিবতের শাস্তি এবং তার প্রতিকার
গিবত একটি কবিরা গুনাহ হিসেবে গণ্য হয়। এর প্রায়শ্চিত্তের জন্য তিনটি শর্ত আছে:
১. আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং গুনাহ থেকে ফিরে আসা।
২. গুনাহের জন্য আন্তরিক অনুতপ্ত হওয়া।
৩. ভবিষ্যতে গিবত পুনরাবৃত্তি না করার দৃঢ় সংকল্প করা।
গিবতের বিষয়টি যেহেতু অন্যের হক সংশ্লিষ্ট থাকে, তাই এসব শর্ত ছাড়াও অতিরিক্ত একটি শর্ত রয়েছে, এবং তা হলো যার সম্পর্কে গিবত করা হয়েছে, তার কাছ থেকে সরাসরি ক্ষমা চাওয়া।
হাদিসে গিবতের ভয়াবহতা
হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘গিবত হলো জিনাহের থেকেও মারাত্মক পাপ। এটি শুনে সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলে, রসুলুল্লাহ সা. বলেন, যেহেতু একজন ব্যক্তি জিনা করে আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন, কিন্তু গীবতকারী যতক্ষণ না তার নিন্দিত ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা পায়, ততক্ষণ সে ক্ষমা পাবে না।’ (আল মু’জামুল আওসাত লিত-তবারানী)
গিবত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাওয়ার নিয়ম
যেহেতু গিবত একটি মানুষের হকের সাথে সম্পর্কিত, অতএব যদি সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ না থাকে, তবে কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। যেমন: যদি সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে তা না বলে, যেখানে গিবত করা হয়েছে, সেখানে ওই ব্যক্তির ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করা যেতে পারে।
যদি তা সম্ভব না হয়, তবে সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া এবং ইস্তেগফার করা যেতে পারে। আর সচরাচর আমরা আমাদের বন্ধু মহলের ভিতরে একে অপরের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের ভাল-মন্দ আলোচনা করতে গিয়ে ইচ্ছা অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্যের গিবত করে ফেলি, আর অনেক সময় দেখা যায় এসমস্ত ব্যাপারে সরাসরি ক্ষমা চাইতে গেলে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির আশঙ্কা কিংবা সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পরের হক নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নেয়া উত্তম।
গিবত বা পরনিন্দা একটি মারাত্মক পাপ, যা সামাজিক অস্থিরতা ও মানহানির কারণ হতে পারে। তাই আমাদের উচিত এই ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে সঠিক পথ অনুসরণ করা।
লেখক: নাজমুল আরিফীন বিন মুহাম্মদ
শিক্ষার্থী: আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো মিশর