সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে একজন বয়স্ক মানুষকে জুতার মালা পরিয়ে অপমান করা হচ্ছে। তাকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়, এবং এর মধ্যে কিছু লোক তাকে জুতার মালা পরিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে। ভিডিওটি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের একটি ঘটনার এবং এতে দেখা যায় ভুক্তভোগী ব্যক্তি, আবদুল হাই ওরফে কানু (৭৮), যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
ঘটনাটি ঘটেছে গত রোববার দুপুরে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। ভিডিওটি ধারণ করে রাতে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। জানা যায়, আবদুল হাই দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তার প্রতিপক্ষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা রয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিওটি নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিছু গণমাধ্যম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবদুল হাইয়ের পরিচয়কে সামনে এনে এ ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছে। তাদের মতে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এমন আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মুক্তিযোদ্ধা না হলে কি এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য হতো?
অতীতেও বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করার নজির রয়েছে। ১৯৯৯ সালে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ যে ভাবে হেনস্তা করেছিল, তা অনেকেরই মনে আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করেছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। এমনকি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকেও ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকাকে দেশে মরার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি হাসিনা সরকার।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা হওয়া কি কারো জন্য সাত খুন মাফের সুযোগ সৃষ্টি করে? নাকি সাধারণ নাগরিকদের প্রতি এমন আচরণও সমানভাবে নিন্দাযোগ্য? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের সবার কাছ থেকে সমান দৃষ্টিভঙ্গি আশা করা উচিত।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একযুগ আগে একটি অনুষ্ঠানের খাবার টেবিল থেকে জামায়াত অনুসারি একজন ব্যবসায়ীকে জোর করে তুলে এলাকাছাড়া করেছিল মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ওরফে কানু। অতপর জামায়াতের ওই ব্যবসায়ী বহু বছর গ্রামের ফিরতে পারেননি। এমনকি স্থানীয় জামায়াতের কয়েকজন নেতাকে এলাকাছাড়া করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা কানু।
ভিডিওতে দেখা যায়, আবদুল হাই ওরফে কানুকে তার এলাকার কিছু মানুষ অপমানিত করে জুতার মালা পরায় এবং এলাকা ছাড়ার জন্য হুমকি দেয়। কানু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ এই লাঞ্ছনা মেনে নেন, যা অনেকটা একজন অপরাধীর শাস্তি গ্রহণের মতো। যদিও এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, প্রশ্ন উঠেছে যে, যারা আওয়ামী লীগ শাসনামলে কানুর অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন, তাদের প্রতিশোধস্পৃহা কি এই ঘটনার পেছনে কাজ করেছে?
গণমাধ্যমে কানুর অতীতের অপকর্ম আড়াল করে তাকে শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, “গণমাধ্যমের উপস্থাপন দেখে মনে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের জুতার মালা পরানো অপরাধ, কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তা ঠিক। আওয়ামী লীগ শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই নৈতিকতা হারিয়েছেন। কানুর মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধা ক্রিমিনাল কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন এবং শেখ হাসিনার শাসনকে সমর্থন দিয়েছেন।”
কানুর পরিবারের অভিযোগ, তাকে লাঞ্ছিত করা জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের কাজ। ঘটনাটি ঘটার পর কানু অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাকে ফেনীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কানু দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নিজ দলের লোকদের অত্যাচারের শিকার হন। এক সময় তিনি চৌদ্দগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের সমর্থনে রাজনীতি করলেও পরে তার বিরোধিতায় চলে যান। মুজিবুলের পক্ষে থাকাকালে তিনি প্রতিপক্ষ নেতাদের ওপর অত্যাচার চালান এবং ধান্দাবাজি করে অর্থ উপার্জন করেন। তার অপকর্মের কারণে এলাকার মানুষ তাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। পরে, মুজিবুলের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হওয়ায় তিনি নিজেও হামলা ও অত্যাচারের শিকার হন এবং প্রায় আট বছর এলাকাছাড়া ছিলেন।
৫ আগষ্ট হাসিনা পালানোনর পর থেকে তিনি বাড়িতে থাকছেন। গত রোববার দুপুরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরই তাঁকে আটক করেন একদল লোক। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। সেখানে তাঁর গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়। লাঞ্ছিতকারীরাই ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করে রাতে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ভিডিওতে দিয়ে দেখা যায়, দুজন ব্যক্তি জুতার মালা পরা অবস্থায় কানুকে টানাহেঁচড়া করছেন। তাঁকে লাঞ্ছিত করা ব্যক্তিদের একজনই পুরো ঘটনার ভিডিও করেছেন। এ সময় কানু কোনো প্রতিবাদ করেননি বারবার তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার আকুতি জানান।
আবদুল হাই কানুর ছেলে গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, হামলাকারীরা সকলেই স্থানীয় জামায়াত ও শিবিরের চিহ্নিত নেতা-কর্মী। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে লাঞ্ছিত করা হলো, আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে কার কাছে বিচার চাইব?
এ প্রসঙ্গে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাহফুজুর রহমান বলেন, ওসি সাহেব আমাকে বিষয়টি জানিয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা মেনে নেওয়ার মতো না। আমরা ঘটনাটির খোঁজখবর নিয়ে দেখছি। জামায়াত ও শিবিরের কোনো নেতা-কর্মী এই ঘটনায় জড়িত হয়ে থাকলে আমরা অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ টি এম আক্তার উজ জামান বলেন, ‘ভিডিওটি দেখে আমি ওই ব্যাক্তির সঙ্গে দুইবার কথা বলেছি। তিনি কোনো অভিযোগ করতে রাজি হচ্ছেন না। বলছেন তিনি অভিযোগ করলে এলাকায় থাকতে পারবেন না, আর থানা পুলিশকেও ঝামেলায় ফেলতে চান না। তবে ওসি বলেন, আমরা এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে চৗদ্দগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাকে মানহানির ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঘটনা তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, আবদুল হাই হত্যাসহ ৯টি মামলার আসামি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সবাইকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে তারা সুবোধ বালকের ভুমিকায় অবর্তীর্ণ হয়েছেন। হাসিনা রেজিমে মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন করা আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা। তাকে গ্রেফতার দূরের কথা তিনি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় তার পক্ষ নিচ্ছে অন্তর্র্বর্তী সরকার! দীর্ঘ ১৫ বছর যারা জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এলাকায় থাকতে পারেননি; ভারতের তাবেদার হাসিনা হটানোর আন্দোলন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের যেন তর সইছে না। এটা ঠিক মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট সন্তান। কিন্তু তারা যদি অপরাধ করেন? শেখ হাসিনা কি মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসিতে ঝুলায়নি?