মোঃ তানিসা আবেদীন, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
দুই দশকের পলাতক জীবন ও আড়াই বছরের জেল জীবনের পর আবারও প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আলোচিত জাকির খান।
হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদকসহ মোট ৩৩টি মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা ৪৮ বছর বয়সী এই নেতা রোববার (১৩ এপ্রিল) নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই বিশাল শোডাউন দিয়ে ঘোষণা দিলেন তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নের।
কারগার থেকে মুক্তি পেয়ে জাকির খান বলেন, “তারেক জিয়ার ৩১ দফা দাবি আজকের এই দিনে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওয়াদা করছি যে, আমরা বাস্তবায়ন করবই করব।
আর আমাদের মুসলিম উম্মার জন্য ফিলিস্তিনে যে ঘটনা হচ্ছে, আমরা সবাই মিলে যদি এটার প্রতিবাদ না করি, তাহলে আমরা আর মুসলমানের কাতারে রইলাম না।”
জেলা ছাত্রদলের সাবেক এই সভাপতি বলেন, “আমার শরীরের চামড়া দিয়ে যদি জুতা বানাই দেই, তাহলেও নারায়ণগঞ্জবাসীর ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না।
আমরা রাজনৈতিকভাবে যেভাবে হেয় পতিপন্ন হয়েছি শেখ হাসিনার গভর্নমেন্টের মাধ্যমে, আমাদের নেক্সট জেনারেশন এ ধরনের সম্মুখীন যেন না হয়। এ জন্য আমরা সর্বোচ্চ ও সব ধরনের ভূমিকা রাখব।”
আত্মগোপন ও জেলজীবনের কারণে দীর্ঘদিন সরাসরি রাজনীতিতে না থাকলেও তার কর্মীরা সক্রিয় ছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনে। নিয়মিতভাবে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ব্যানারে তার কর্মীরা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতো।
এই দীর্ঘসময়েও অনুসারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল তার। কারামুক্তির পর বিশাল শোডাউনে তার প্রমাণ মেলে। রাজনীতিতে তার প্রভাব এখনো কতখানি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন একসময়ের ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’র তকমা পাওয়া জাকির খান।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শহরের মাসদাইর এলাকায় নিট পোশাক ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকারকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় প্রধান আসামি করা হয় জাকির খানকে।
সাব্বির ছিলেন বিকেএমইএ’র সাবেক সহসভাপতি এবং তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই। এরপর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, তিনি প্রথমে থাইল্যান্ড ও পরে অন্যান্য দেশে অবস্থান করেন। ভারতেও ছিলেন দীর্ঘদিন৷ তবে, গ্রেপ্তারের আগে কয়েক বছর বাংলাদেশে যাতায়াত ছিল তার৷
গত ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১। দীর্ঘ কারাভোগের পর চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সাব্বির হত্যা মামলায় খালাস পান জাকিরসহ সব আসামি।
জাকিরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাজীব মণ্ডল জানান, “জাকির খান ৩১টি মামলায় খালাস পেয়েছেন, বাকি দুটি মামলায় জামিনে আছেন। এখন তার বিরুদ্ধে আর কোনো আইনি বাধা নেই।”
যেভাবে উত্থান জাকির খানের
নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজ থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে আসা জাকির হোসেন ওরফে জাকির খান এক সময় শহরের ‘ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তিনি জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হন। সাব্বির আলম খন্দকার হত্যার পর আসামি হিসেবে নাম এলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
প্রায় দুই দশক পর আগ্নেয়াস্ত্রসহ তাকে গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১১ এর তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বলেন, সাব্বির হত্যা মামলার পর জাকির থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান।
পলাতক থাকা অবস্থাতেই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় আদালত সাজা প্রদান করে। এরপর থেকে তিনি আর দেশে ফেরেননি। এক বছর আগে ভারত হয়ে দেশে ফিরে আসেন।
জাকিরের নামে চারটি হত্যা মামলাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে উল্লেখ করে র্যাব জানায়, নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকায় বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী ও মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন জাকির খান।
দেওভোগ এলাকার অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী দয়াল মাসুদকে শহরের সোনার বাংলা মার্কেটের পেছনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে শহরের ত্রাস হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী।
“জাকির খানের বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে সন্ত্রাসমূলক অপরাধ দমন বিশেষ আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় তার ১৭ বছরের সাজা হয়। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে তার সাজা কমে আট বছর হলেও তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে দেশে ও বিদেশে প্রায় দুই দশক পলাতক ছিলেন।”
স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী জানান, ১৯৮৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রয়াত সংসদ সদস্য এ কে এম নাসিম ওসমানের হাত ধরে জাকির জাতীয় ছাত্রসমাজে যোগ দেন। ওই নেতার সঙ্গে বিরোধের জেরে ১৯৯৪ সালে তিনি ছাত্রদলে যোগ দেন।
১৯৯৯ সালে সালে জাকির জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হন। তখন শহরের ডিআইটিতে তাকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক দফা জেলও খাটেন তিনি।
গত ৫ অগাস্ট শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে শহরের পরিবহন, ঝুটসহ বিভিন্ন সেক্টরে জাকির খানের অনুসারীদের দখল ও আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ ওঠে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি পরিবহন দখলকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে জাকির খানের অনুসারীদের সঙ্গে বিএনপির আরেকটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এই সময় গুলিও চলে।
কারামুক্তির পর সমালোচিত জাকির খান
কারামুক্তির পরপরই শতাধিক মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের বহর নিয়ে শহরে প্রকাশ্য শোডাউন করেন তিনি। এতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক, বঙ্গবন্ধু সড়কসহ আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। কারাফটকের সামনে সকাল থেকেই ফুলের মালা ও ব্যানার হাতে জড়ো হন জাকিরের শত শত অনুসারী।
সকাল সোয়া ১০টার দিকে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শোডাউনে বের হন জাকির খান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে ভোগান্তিতে পরেন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
জাকিরের সঙ্গে এক সময় চরম দ্বন্দ্বে জড়ান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান৷ টানবাজারর যৌন পল্লী উচ্ছেদের পর অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে জাকির খানের পরিবার,
যা তাদের দ্বন্দ্ব তীব্র করে৷ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর শামীম ওসমান শহর ছেড়ে পালানোয় জাকির খানের প্রতিদ্বন্দ্বীতার চ্যালেঞ্জ কমেছে৷ তবে জাকির খান তাক সন্ত্রাসী তকমা ঝেড়ে পরিপাটি রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন কিনা সে প্রশ্ন জেগেছে নারায়ণগঞ্জবাসীর মনে৷

এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব বলে কি আপনি মনে করেন?