দেশের বিভিন্ন জেলায় নেতাকর্মীদের মাঝে হট্টগোল, হাতাহাতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতাদের একের পর এক নিয়ন্ত্রণহীন স্ট্যাটাসে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
বিশেষ করে দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শীর্ষ নেতাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস বেকায়দায় ফেলছে দলটিকে। এমন পরিস্থিতিতে দলের ভেতরে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর হচ্ছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা; তৈরি করা হচ্ছে শৃঙ্খলাবিধি। পাশাপাশি বক্তব্য, বিবৃতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাসসহ নানা বিষয়ে দেওয়া হচ্ছে সতর্কবার্তা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি দলের দুই মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে এনসিপি। বিশেষ করে দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এভাবে পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাস দেওয়া এবং অন্য শীর্ষ নেতারা মন্তব্য করায় দলের
ভেতরে যেমন অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, তেমনি দলের বাইরেও বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শীর্ষনেতাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে। তাদের কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
তারা বলছেন, এসব কারণে আগামীতে এনসিপির সঙ্গে কেউ অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বসতে স্বস্তিবোধ না-ও করতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে দলের শৃঙ্খলার বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছেন এনসিপির নীতিনির্ধারকরা। তারা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলীয় কোনো ইস্যুতে ব্যক্তিগত মতামত দিতে পারবেন না নেতারা। এ নিয়ে একটা শৃঙ্খলাবিধিও তৈরি হচ্ছে, প্রস্তাব পাস হয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সব নেতার স্বাক্ষর নেওয়া হবে। এ ছাড়া সাংগঠনিক যে কোনো বিষয়ে বক্তব্য-বিবৃতিতে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুকে লেখেন, গত ১১ মার্চ তিনিসহ দুজনকে ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। হাসনাতের সেই পোস্টের পর বিষয়টি নিয়ে দুদিন ধরে নানা আলোচনা চলে।
এর মধ্যে রোববার ফেসবুক পোস্টে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম লেখেন, ‘যেভাবে এই কথাগুলো ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে, এই প্রক্রিয়াটি আমার সমীচীন মনে হয়নি।’ সারজিসের এই পোস্টের নিচে মন্তব্যের ঘরে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘এসব কী ভাই! পাবলিকলিই বলছি, দুজনের একজন মিথ্যা বলছেন। এটা চলতে পারে না।’
শীর্ষনেতাদের এমন ‘অসাংগঠনিক’ কার্যক্রমে বিব্রত ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলটির কেন্দ্রীয় অন্য নেতারা। তারা বলছেন, সেনাপ্রধানের সঙ্গে হাসনাত-সারজিসের আলোচনার বিষয়টি দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়নি। তারা ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ নেতা জানতেনই না।
এ ছাড়া অনানুষ্ঠানিক এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা বাহিনীর আলাপকে তারা যেভাবে প্রকাশ্যে এনেছেন, তাতে দলের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। অনেকে এনসিপি নিয়ে হাসাহাসিও করছেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা বলেন, দলের অন্যতম স্টেক হওয়া সত্ত্বেও যে যার মতো স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ বিষয়টি জানেনই না। এটা চরম বিব্রতকর। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জনের রাজনীতি করছেন অনেকে।
ডেকোরামের কাউকে হুটহাট ফেসবুকে পোস্ট না দেওয়ার বিষয়ে বলা হলেও কেউ মানছেন না। দিনশেষে এটি নতুন দলের জন্য অস্বস্তির। কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য নেতারা সবাই এতে ক্ষোভ জানিয়েছেন এবং দলের আহ্বায়ক সদস্য সচিবকে বিষয়টি নিয়ে ভাবার অনুরোধ জানিয়েছেন।
এ ছাড়া সিলেটে এনসিপির ইফতার মাহফিলে নেতাকর্মীদের মধ্যে হট্টগোল, হাতাহাতি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনা, এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদের সামনেই নেতাকর্মীদের হাতাহাতিসহ বিভিন্ন জেলায় বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড দলটিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে।
এসব বিষয়েও কেন্দ্র থেকে দেখভালের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, শৃঙ্খলাবিধির বিষয়ে একটা প্রস্তাব পাস হয়েছে। কোন ইস্যুগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলা যাবে, কোনগুলো নিয়ে যাবে না, সেসব নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
সব কেন্দ্রীয় নেতা এতে স্বাক্ষর করবেন, এরপর এটি চূড়ান্ত হবে। সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বিষয়ে এনসিপি গুরুত্ব দিচ্ছে।
দলটির সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বিষয়ে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘নতুন দলের জন্য সাংগঠনিকভাবে স্থির হতে একটু সময় লাগে। তাই কিছুটা বিশৃঙ্খলা হওয়া স্বাভাবিক। এটি সাংগঠনিক স্ট্রাকচারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে না।
নতুন দল হিসেবে আমাদের অনেক কিছু শিখতে হচ্ছে, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে কিছু নির্দেশনা আমাদের দ্রুত নিতে হবে। যেমন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে কী ধরনের সতর্কতা এবং সচেতন থাকা উচিত, সেটা নিয়ে আমরা এখন থেকে কাজ করব।
এটা আমরা আগে মৌখিকভাবে বললেও এখন থেকেই পালন করার নির্দেশনা দেব। পার্টির সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত—পার্টির রাজনৈতিক লাইন অনুযায়ীই নেতারা কথা বলবেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সিদ্ধান্তগুলো আমরা এখন নিতে যাচ্ছি।’
এর আগে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, ‘একটি বিশাল অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। আন্দোলন এবং পলিটিক্যাল জায়গা—দুটি আলাদা জায়গা।
সে জায়গা থেকে এই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্ররা নিজেদের পলিটিক্যাল জায়গাটায় ট্রান্সফরমেশন করতেছে। সে জায়গায় কিছু ক্ষেত্রে যদি ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, দেশবাসীকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এনসিপির নেতাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব বা বোঝাপড়ার জায়গায় ঘাটতি নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ বছরের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ বছরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব বলে কি আপনিও মনে করেন?