আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র ১৪ দলের শরিকরা অবশেষে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছেন। দীর্ঘ ১৬ বছরের রাজনৈতিক সম্পর্কের দায় আর বহন করতে চান না তারা। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনামল, দুর্নীতি, লুটপাট, দমন-পীড়ন এবং সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট গণহত্যার দায়ভার থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে চাইছেন এই জোটের বেশিরভাগ দল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে পথচলার জন্য ‘দুঃখ প্রকাশ’ করে, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরতে চান।
১৪ দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, তারা কেবল জোটের শরিক ছিলেন এবং তাদের দলগুলোর হাতে বাস্তবিক কোনো ক্ষমতা ছিল না। তারা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ছিলেন না, বরং আওয়ামী লীগ একক আধিপত্যে দেশ শাসন করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে অতীতের জোটসঙ্গী হওয়ার কারণে জনগণের মধ্যে তারা এখন সন্দেহের দৃষ্টিতে পড়েছেন, যা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে তুলেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা, বহু মন্ত্রী-এমপি গ্রেপ্তার হন, কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যান। দেশের নানা জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জনরোষের শিকার হয়। দলটির বেশিরভাগ নেতাকর্মী এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পতনের সঙ্গে সঙ্গে ১৪ দলের শরিকরাও সংকটে পড়েছেন।
বিশেষ করে, ফ্যাসিবাদী সরকারের সহযোগী হিসেবে পরিচিত ১৪ দলের বেশ কিছু নেতা এখন জেলবন্দি। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সরাসরি জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে আছেন। এদিকে, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক শক্তিগুলো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পাশাপাশি ১৪ দলেরও নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে, যা শরিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
তবে ১৪ দলের বেশ কয়েকটি দল নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষায় নড়েচড়ে বসেছে। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ সীমিত পরিসরে ঘরোয়া বৈঠক, আলোচনা সভা এবং বিবৃতির মাধ্যমে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে। গণতন্ত্রী পার্টির একটি অংশ জাতীয় দিবসগুলোতে কিছু কর্মসূচি পালন করছে, তরীকত ফেডারেশন মাঝে মাঝে বিবৃতি দিয়ে নিজেদের জানান দিচ্ছে, আর বাসদ (রেজাউর) জেলা ও উপজেলা সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে বাকি শরিক দলগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। জাতীয় পার্টি (জেপি), ন্যাপ, সাম্যবাদী দল, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং গণতন্ত্রী পার্টির (শাহাদাৎ) কোনো কার্যক্রমই দৃশ্যমান নয়। তারা প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতেও ভয় পাচ্ছে। তবে টেলিফোন ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে নেতারা নিজেদের ভবিষ্যত রাজনীতি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৪ দলের কিছু সিনিয়র নেতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে অতীত জোটসঙ্গী হওয়ার জন্য জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা বলেন, “আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা আমাদের জন্য এখন অভিশাপ হয়ে গেছে। আমরা জোটের নামে শুধু নাম লিখিয়েছিলাম, কিন্তু ক্ষমতায় কোনো অংশীদারিত্ব পাইনি। এখন সেই পুরনো সম্পর্ক আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কারণে আমাদেরও রাজনীতির মাঠ সংকুচিত হয়ে পড়েছে।”
গণতন্ত্রী পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে, স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছে, দুর্নীতি করেছে, আমরা এসবের অংশ ছিলাম না। সুতরাং, আওয়ামী লীগের অপকর্মের দায় আমরা নেব না।”
বাসদের (রেজাউর) আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান বলেন, “গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ যে নৃশংসতা ও দুর্নীতি করেছে, তার দায়ভার তারা নিজেদেরই নিতে হবে। ১৪ দলের শরিকরা এতে দায়ী নয়। তারপরও, আমরা অতীতের এই রাজনৈতিক সঙ্গের জন্য জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে চাই এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরে যেতে চাই।”
১৪ দলের অন্য শরিক দলগুলোর মধ্যেও একই ধরনের সুর শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের পতনের পর শরিক দলগুলোর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনেকেই নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন, কেউ কেউ নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করে রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। তবে একথা নিশ্চিত, ক্ষমতা ভাগাভাগির রাজনীতি শেষ হয়েছে এবং নতুন বাস্তবতায় ১৪ দলের শরিকরা এখন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সময় কোনো বিষয় নয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনই আসল কথা। তাঁর এই বক্তব্যে আপনার সমর্থন আছে কি?