বিশ্ব রাজনীতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রভাব দিন দিন আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষতাবিষয়ক মন্ত্রী ইলন মাস্ক সরাসরি ফোন করে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছেন। হৃদ্যতাপূর্ণ এই আলোচনায় ড. ইউনূস ইলন মাস্ককে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই ঘটনাটি শুধু একটি সাধারণ যোগাযোগ নয়, বরং বাংলাদেশের পরিবর্তিত কূটনৈতিক অবস্থানের প্রতিচ্ছবি।
মাত্র সাত মাসেরও কম সময় ধরে দায়িত্বে থাকা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কেবল রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে উঠছে না, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও একটি মর্যাদার জায়গা করে নিচ্ছে। একসময় বাংলাদেশের নেতাদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃতি পেতে প্রচুর লবিং করতে হতো, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সুযোগ পেতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হতো। অনেক ক্ষেত্রেই তা সফল হতো না। অথচ আজ বাংলাদেশ বিশ্ব নেতৃত্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক নেতারা বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক করতে আগ্রহী, বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে গুরুত্বের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে অংশগ্রহণের সময় ড. ইউনূস একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেন। তিনি সম্মেলনের প্রধান প্লেনারি সেশনে বক্তব্য রাখেন, যা স্বয়ং সিএনএনের বিখ্যাত সাংবাদিক বেকি অ্যান্ডারসন পরিচালনা করেন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। অতীতে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এমন মর্যাদা পাননি।
এছাড়াও, গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অংশগ্রহণের সময় ড. ইউনূস প্রচলিত ধারা ভেঙে একটি ছোট প্রতিনিধি দল নিয়ে যান এবং অত্যন্ত কার্যকরভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশ পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সহায়তা চান। অতীতে এ ধরনের সফরগুলোতে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করা হতো, যেখানে ড. ইউনূস নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ সম্মেলনেও তার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই সম্মেলনে তিনি তার ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একসময় বাংলাদেশ এসব সম্মেলনে গিয়ে শুধু সাহায্যের আবেদন করত, কিন্তু এখন দেশ নিজেই সমাধান প্রস্তাব দিচ্ছে।
এ বছরের শুরুতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ড. ইউনূস বিশ্বনেতাদের কাছে বাংলাদেশের নতুন কৌশল ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দেশের পুনর্নির্মাণের বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন।
এই কূটনৈতিক সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, অতীতে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানেরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য লবিং করতেন, কিন্তু ড. ইউনূস ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না। গত ছয় মাসে এই পরিবর্তন বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
শুধু দেশের বাইরে গিয়ে কূটনীতি নয়, দেশে থেকেও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে নেওয়া যায় এবং বাংলাদেশের যে প্রয়োজনগুলো সেই প্রয়োজনের জন্য উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে আহবান জানানো হয়। আমরা লক্ষ করব, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে দেশগুলোর বাংলাদেশে অফিস নেই, দিল্লি থেকে কাজ করে, সেসব মিশনপ্রধানকে ঢাকায় আসার জন্য আহবান জানিয়েছেন। এটি ড. ইউনূসের পক্ষেই সম্ভব। ২৬টি দেশের মিশনপ্রধানরা দিল্লি থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য। বাংলাদেশ এ রকম কূটনৈতিক সাফল্য অতীতে কখনো অর্জন করেছে কি না কারো জানা নেই। শুধু তাই নয়, এই সময়ের মধ্যে তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং সরকারপ্রধানের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁরা কথা বলেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, সেই প্রতিবেদনটি প্রকাশের ক্ষেত্রেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনন্য অবদান ছিল। কারণ এত দ্রুত সময়ে এবং এত স্পষ্ট ভাষায় জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন দেওয়া সত্যিই একটি বিরাট ব্যাপার। এই প্রতিবেদন জুলাই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে সাবেক সরকার যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নৃশংস পদক্ষেপ নিয়েছিল, তাকে রাজনৈতিক আলোচনার বাইরে একটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। জুলাই গণহত্যা নিয়ে সব বিতর্কের অবসান হয়েছে। আমরা দেখি, এই ধরনের অপকর্মের পর অনেকেই এটিকে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে নিয়ে যান এবং এটিকে একটি বিতর্কিত বিষয় হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন যখন গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়, তখন এটি নিয়ে আর কোনো বিতর্ক থাকে না। এটি সম্ভব হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য, যিনি এরই মধ্যে বিশ্বে বরেণ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাই তাঁর নিজেকে তুলে ধরার কিছু নেই। তিনি তাঁর সারা জীবনের অর্জন, সারা জীবনের সুনাম, সারা জীবনের পরিচিতি ব্যবহার করছেন বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি নতুন ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। এই সময় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সমর্থন এবং সহানুভূতি অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে নানা রকম টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সময় বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। আর এ কারণেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কূটনীতি হলো বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সাহায্য-সহযোগিতা এবং অনুকম্পা, নির্ভরতা কূটনীতির পাশে তিনি গত ছয় মাসে একটি মর্যাদা এবং সহযাত্রার কূটনীতি চালু করেছেন। যে কূটনীতি বাংলাদেশকে নতুন পরিচয়ে উদ্ভাসিত করেছে বিশ্বের মানচিত্রে।

সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা পরিকল্পিত বলে সন্দেহ করছেন অনেকে। আপনি কী মনে করেন?