দেশের গভীরে প্রবেশ করা দুর্নীতির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘দুর্নীতি সবকিছু শেষ করে দিচ্ছে। আমরা যদি এটি থেকে বের হতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’
রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের সামনে অসীম সম্ভাবনা রয়েছে, আমাদের শুধু সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজন। আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, তবে দুর্নীতির কারণে সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটি আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং যদি আমরা এই সমস্যার সমাধান না করতে পারি, তাহলে উন্নতির কোনো পথ থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের যেকোনো দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ নিচের দিকেই থাকে। সততা ও শৃঙ্খলা বলে দেশে তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। দুর্নীতি মুক্ত না হলে আমরা কোনো ভালো কিছু করতে পারব না।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা আজ এখানে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের সম্মেলনে একত্র হয়েছি। আপনারা ভালোভাবেই জানেন দুর্নীতি কোথায়, কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। একে নির্মূল করা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি দুর্নীতির এই জাল থেকে বের হতে না পারি, তাহলে দেশ সামনে এগোতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির প্রভাব থেকে আমরা কেউ মুক্ত নই। এটি আমাদের সমাজে এতটাই গভীরে প্রবেশ করেছে যে, যত কথাই বলা হোক, যত বক্তৃতাই দেওয়া হোক, যদি আমরা নিজেদেরকে সৎ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তাহলে এসব প্রচেষ্টা অর্থহীন হয়ে যাবে।’
দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা স্বল্প সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করছি, তাই কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারব, তা এখনই বলা কঠিন। তবে আমরা শুরু থেকেই দুর্নীতি প্রতিরোধের চেষ্টা করছি। সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং এই দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
দুর্নীতি থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে অনলাইন কার্যক্রম বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যেসব জায়গাগুলোতে অনলাইন ব্যবস্থা আছে সেগুলো পুরোপুরি কার্যকর করতে হবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চায় আমরা দুর্নীতি মুক্ত হই। কারণ দুর্নীতি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই চলছে না। তারাও চায় আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য হোক, এটা তাদের গবেষণা। আমরা তাদের সুযোগ দিতে চাই না। আমরা ব্যক্তিগত সুযোগ নিয়ে ব্যস্ত আছি। জাতীয় সুযোগের জন্য আমরা মোটেই চিন্তিত নই। আমাদের সেই চিন্তা বদলে ফেলতে হবে।’
তিনি বলেন, যারা সরকারি কার্যক্রমে যুক্ত আছেন তাদের অনুরোধ জানাই দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে। দুর্নীতি থেকে সরকারকে বের হতে হবে। সরকার যদি দেশের উপকারে আসতে চায়, তাহলে এটা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে হবে।
অনলাইন সেবা চালু করার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনাদের এই আবেদন করবো, আমরা থাকা অবস্থায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অনলাইন সার্ভিস, যেগুলো তৈরি আছে সেটা শতভাগ যেন আমরা বাস্তবায়ন করে যেতে পারি।’
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, কেউ এটা বাধা দেওয়ার জন্য যেন কোমর বেঁধে না লেগে যায়। কোমর বেঁধে লেগে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ এটি (দুর্নীতি) দিয়েই তো তারা সব সুযোগ সুবিধা পেতো। এটা বন্ধ হয়ে গেলে তাদের হবেটা কী? তারা নানা ব্যাখ্যা দিবে এটা ব্যাহত করার জন্য। আমরা তাদের (দুর্নীতিবাজদের) মুক্তি দিতে চাই না।
তিনি বলেন, এটা হলো লোহার ফটক (দুর্নীতি), এটা অতিক্রম না করলে উন্নতি বলেন, কিছুই আসবে না। কিচ্ছু হবে না। সম্মান, উন্নতি যাই বলেন কিছুই হবে না। এটা ভদ্র লোকের সংসারের মতো হতে হবে। যে আমরা দুর্নীতি মুক্ত জাতি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সিঙ্গাপুরের মতো দেশ যদি দুর্নীতি মুক্ত হতে পারে। তাহলে আমরা কেন পারব না। সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরাও পারব।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতি থেকে বিভিন্ন দেশ বের হয়ে এসছে, এটা সম্ভব, অসম্ভব কিছু না। শুধু চেষ্টার দরকার। শুধু আমাদের প্রতিজ্ঞা দরকার, এটা আমরা করবো।
সম্প্রতি আরব আমিরাত সফরের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আরব আমিরাতের লোক আমাদের দুর্নীতি নিয়ে বলছে, আমরা তোমাদের কোন ডকুমেন্ট বিশ্বাস করতে পারছি না। এত ভুয়া। গৃহকাজের লোক কিন্তু সে সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছে মেডিকেল ডক্টর হিসেবে। জলজ্যান্ত আমরা দেখছি এ ডাক্তার হতে পারে না। সে ডাক্তার না, কিন্তু সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছে। ডাক্তারে সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি নিয়ে ওখানে আসছে। আমরা কতটা বাছাই করবো। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় যে, আমরা এটা কিছুই করতে পারছি না। আমরা কেউ না কেউ তাকে এই সার্টিফিকেট দিচ্ছি। এজেন্টরা যোগাড় করে দেয়, শুধু একটা এজেন্ট না বহু এজেন্ট আছে।’
তিনি বলেন, এভাবে আমাদের বহু মেয়ে মধ্যপ্রাচ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে গিয়ে কিসের মধ্যে ফেলে দিয়েছে কেউ জানেও না। মানব পাচারের যে বিষয় তা অত্যন্ত বীভৎস। আমাদের মেয়েরা যাচ্ছে, কি অবস্থায় ফিরে আসছে, যদি স্বশরীরে ফিরে আসতে পারে। কত লাশ কোথায় চলে যাচ্ছে সেটারও কোনো হিসাব নেই। এই কোন দেশ বানালাম আমরা। আমরা তো দায়ী।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নিজের কাছে, নিজের সন্তানদের কাছে আমরা কি জবাব দেবো যে, কাউকে আমরা রক্ষা করতে পারছি না। এই মৃত্যুর জন্য, এই মানব পাচারের জন্য আমরা দায়ী না।
তিনি বলেন, এ ভীষণ রোগ, আমাদের সারা গায়ে ঘা, এটা থেকে মুক্ত হতে না পারলে কোন দিকে অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই। আমরা আজকে প্রতিজ্ঞা করি, আমরা এই ঘা থেকে মুক্ত হবো, সুস্থ হবো, দুর্নীতির দায়ে আমাদের কেউ অভিযুক্ত করতে পারবে না। এই রকম সরকার চালাবো, এ রকম সমাজ চালাবো।

বাংলাদেশের পুলিশ, র্যাব ও আনসারের ড্রেস নিয়ে আপনার মতামত কী?