রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫
৪ মাঘ, ১৪৩১

পরিক্ষামূলক সংস্করণ

জাতীয়

সাবেক আইজিপি বেনজীরের ক্যাশিয়ার মিজান গ্রেফতার

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশঃ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৯

সাবেক আইজিপি বেনজীরের ক্যাশিয়ার মিজান গ্রেফতার
রংধনু গ্রুপের পরিচালক ও রূপগঞ্জ উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ভাটারা থানার যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। মিজানুর রহমান রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের ভাই এবং রফিকুলের সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান হিসেবে পরিচিত।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মো. ওবায়দুর রহমান কালের কণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, ভূমি দখল, লুটপাট, মারামারিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে ডিবি পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলোর যেকোনো একটিতে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রফিকুল ইসলাম ও মিজানুর রহমানের মাধ্যমে পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থের বিশাল একটি অংশ বিনিয়োগ করেছেন, বিশেষ করে দুবাই, সিঙ্গাপুর, কক্সবাজার ও ঢাকায় বিভিন্ন হোটেল এবং স্বর্ণ ব্যবসায় এই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে।
রফিকুল-মিজানুরের মাধ্যমে বেনজীরের বিদেশে বিনিয়োগের অন্যতম দুবাইয়ে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা।
রফিকুল ইসলামের সঙ্গে বেনজীরের মালিকানায় দুবাইয়ের হোটেলটির নাম রয়াল কনকর্ড হোটেল অ্যান্ড সুইট। বিলাসবহুল এই হোটেলের অবস্থান দুবাই শহরের কেন্দ্রস্থল মাকতুম স্ট্রিটে। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুবাই ক্রিক, গলফ ও ইয়ুথ ক্লাব, সোনা ও মসলার বাজার এবং কেনাকাটা ও অবসর কেন্দ্রগুলোর খুব কাছে হোটেলটির অবস্থান।
দুবাই গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে এর দূরত্ব তিন কিলোমিটার।
রফিকুল-মিজানুরের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার করে গড়ে তোলা বেনজীরের এই হোটেলে আছে অ্যাপার্টমেন্ট, এক্সিকিউটিভ, সুইটসহ অত্যাধুনিক রুম। যেগুলোর ভাড়া ৩৫০ দিরহাম থেকে শুরু করে এক হাজার ৫০০ দিরহাম। টাকায় হোটেলটির রুমভাড়া ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত এই দুই ভাইয়ের মাধ্যমে বেনজীর সিঙ্গাপুরে গড়ে তুলেছেন সোনার ব্যবসা।
তাঁর জুয়েলারি শপটির নাম নিজি জুয়েলার্স (হরলর লবিষবত্ং)। এটির অবস্থান সিঙ্গাপুরের মুস্তফা মার্কেটের পাশে। দেশ থেকে পাচার করে প্রতিষ্ঠানটিতে বেনজীর প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
দুবাই-সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি রফিকুল-মিজানুরের মাধ্যমে বেনজীরের অবৈধ টাকা কক্সবাজারের কলাতলিতে দুটি বিলাসবহুল হোটেলে বিনিয়োগ করা হয়েছে। হোটেল দুটি হলো—হোটেল বেস্ট ওয়েস্টার্ন প্রিমিয়ার ও হোটেল রামাদা লিমিটেড। একইভাবে বনানীর সি ব্লকের ১৫ নম্বর রোডের ৫৯ নম্বরে বেনজীরের অবৈধ টাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে হোটেল ইউনিক রিজেন্সি।
রফিকুল-মিজানুর আয়নাঘরের কারিগর চাকরি হারানো বিতর্কিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে শতকোটি টাকার বাগানবাড়ি উপহার দিয়েছেন। বেনজীর-জিয়াউলের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দুই ভাই রূপগঞ্জ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভোট জালিয়াতি করে মিজানুর রহমান রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) রংধনু গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে মিজানুর রহমানের অর্থপাচারের অভিযোগের তদন্তও করা হচ্ছে।
মিজানুর রহমান রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান আপন ভাই রফিকুল ইসলামের ছত্রচ্ছায়ায় রূপগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। মিজানুর-রফিকুল দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে জমি নিয়ে একাধিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রূপগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, বিনা অপরাধে মানুষের ওপর অত্যাচার, মাদক বাণিজ্যসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, রফিকুল ইসলামের গড়ে তোলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেউ কথা বলা সাহস পায়নি। কারণ যাঁরা কথা বলেছেন কিংবা মামলা করেছেন, তাঁদের হত্যা কিংবা নির্যাতন চালিয়ে এলাকাছাড়া করেছেন মিজানুর রহমান। রফিক-মিজান মিলে দুই শতাধিক পরিবারকে এলাকাছাড়া করেছেন। দুই ভাই মিলে সাধারণ মানুষের জমি জবরদখলসহ মাদরাসা, ঈদগাহ, কবরস্থানের জমিও দখল করেছেন।
গত বছর ৪ ডিসেম্বর নৌ পুলিশের সদস্যরা রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নাওড়া বাজারের পাশে সেতুর নিচ থেকে শিশু ওসমান গণি স্বাধীনের লাশ উদ্ধার করেন। শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, শিশুটিকে রফিকুল ইসলামের নির্দেশে তাঁর ভাই মিজানুর রহমান হত্যা করেন।
এ বিষয়ে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে শিশুটির পরিবার। সংবাদ সম্মেলনে স্বাধীনের বাবা শাহিনুর রহমান বলেনছিলেন, ‘আমার সন্তানের হত্যাকারী কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের মালিক রফিকুল ইসলাম এবং তার ভাই মিজানুর রহমান। রফিকুল ইসলামের কথামতো বাড়ি-জমি লিখে না দেওয়ায় আমার শিশুসন্তান স্বাধীনকে হত্যা করা হয়। তারা এত প্রভাবশালী যে সন্তানকে কবর দেওয়ার পর থেকে আমরা আর বাড়িতে থাকতে পারি না। থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেয়নি।’
মিজানুর রহমানের গ্রেপ্তারের বিষয়ে শাহিনুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রফিক এলাকায় এত বেশি প্রভাবশালী ছিল, আমি সন্তান হত্যার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করতে পারিনি। থানায় গেলে হত্যার বদলে অপমৃত্যুর মামলা করতে পরামর্শ দেয় রূপগঞ্জ থানা পুলিশ।’
তিনি আরো বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত মিজানুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছে। আশা করি এবার আমার শিশুসন্তানের হত্যার বিচার পাব। শিশুসন্তান হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে আমি বর্তমান সরকারের কাছে আহ্বান জানাই।’
হত্যা, জমিদখল, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে রফিক-মিজানের বাহিনীর কথা উল্লেখ করে এক ভুক্তভোগী জয়নাল মিয়া বলেন, ‘রফিক তার বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করেছে। এজন্য তার ভাই মিজানুর রহমান এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ জনের বাহিনী গড়ে তোলে। এদের সবার কাছে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এলাকার কেউ অভিযোগ দিলেও পুলিশ কখনো তাদের গ্রেপ্তার করেনি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দুই কুখ্যাত সন্ত্রাসীর একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। মিজানের গ্রেপ্তারের খবরে এলাকার মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। আমরা চাই, রফিককেও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক।’
কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ভুক্তভোগী কবির হোসেন বলেন, ‘রফিক ও মিজানের নিপীড়নের শিকার হয়নি এই নাওড়ায় এমন কোনো মানুষ নেই। দুই ভাইয়ের অত্যাচার থেকে হিন্দু-মুসলমান কেউ বাদ যায়নি। সবার জায়গায় জোর করে বালু ফেলে ভরাট করে দখলে নিয়েছে তারা।’
ভুক্তভোগী আফরোজা বেগম বলেন, ‘এখন আর আমাদের কিছু নেই। মিজানুর তার বাহিনী নিয়ে হামলা চালিয়ে সব দখলে নিয়েছে। বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দিয়েছে। ছেলে- মেয়ে নিয়ে এখন বাবার বাড়িতে থাকি।’
মিজানের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য মামলা
মিজানুর রহমানকে আসামি করে সোনারগাঁ থানায় মামলা করেন মো. হানিফ নামের এক ব্যক্তি। মামলা নম্বর ১৬/৩১৯। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মারধর করা, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো, হত্যার হুকুম দানের অপরাধে মামলাটি করা হয়। আরেক মামলার বাদী মো. আইয়ুব আলী। মামলা নম্বর ১৯/৩৫০। রূপগঞ্জ থানায় করা মামলার এজাহারে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করাসহ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানোর পাশাপাশি গুরুতর জখম, হুকুম দেওয়াসহ প্রাণনাশের হুমকির অপরাধ উল্লেখ করা হয়।
মো. আফজাল কবির নামের আরেক ব্যক্তি রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর ২০/৩৫১। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয় ভাঙচুর, চুরি ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ। মো. শিহাবুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তি রাজধানীর মিরপুর থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর ৭৫৪/২০২৪। মো. বাবুল সিকদার নামের আরেকজন রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর ২১/৩৫২। এই মামলার এজাহারে ভাঙচুর ও চুরির পাশাপাশি প্রাণনাশের হুমকির অপরাধের কথা বলা হয়েছে। মো. হানিফ নামের আরেক ব্যক্তি সোনারগাঁ থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর ১৬/৩১৯। মামলার এজাহারে হত্যা, মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মারধর ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ করা হয়েছে।
মো. শিহাবুল ইসলাম নামে একজন (সিআর মামলা) এজাহারে ৩০২, ১৪৯ ও ৩৪ দণ্ডবিধি ১৮৬০ ধারায় অভিযোগে এনেছেন। মো. শুভ নামের একজন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩-এর ৩(২) ও ৪(২) ধারা অনুযায়ী গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছেন। মো. বিল্লাল হোসেন নামের একজন রূপগঞ্জ থানায় করা মামলায় (মামলা নম্বর ২২/২১০) ১৪৩/৪৪৭/৪৪৮/৩০২/৩২৬/৩০৭/৩৭৯/৪২৭/১১৪/১৪৯ ধারায় মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগে এনেছেন। মো. সুমন নামের একজন রূপগঞ্জ থানায় করা মামলায় (মামলা নম্বর ৩৬/৭৪৩) হুকুম দিয়ে প্রাণনাশের হুমকির পাশাপাশি ভাঙচুর ও চুরির অভিযোগ এনেছেন। মো. আলী আজগর ভুঁইয়া নামের একজন (সিআর মামলা নম্বর ৪৩৮/২০২৩) এজাহারে ১৪৩/৪৪৮/৩২৭/৩০৭/৪২৭/৫০৬ দণ্ডবিধির অভিযোগ এনেছেন। এ ছাড়া শাহীন নামের একজন (সিআর মামলা নম্বর ১১/২২৪ খিলগাঁও) একটি মামলা করেছেন।  এর বাইরে শাহীনুর নামের একজন খিলগাঁও থানায় করা মামলায় মিজানের বিরুদ্ধে (মামলা নম্বর ১১/২০২৪) ৩৬৪/ক, ৩০২, ২০১, ৩৪, ৫০৬ দণ্ড বিধির অভিযোগ করেছেন।

এ সম্পর্কিত আরো খবর