শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫
১০ মাঘ, ১৪৩১

পরিক্ষামূলক সংস্করণ

জাতীয়

টেবিলে বই, আলনায় কাপড় সবই আছে, নেই শুধু আমার ছেলেটা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশঃ ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৫

টেবিলে বই, আলনায় কাপড় সবই আছে, নেই শুধু আমার ছেলেটা

বারবার হাত দিয়ে ধরে দেখছিলেন জিনিসগুলো। ছেলের স্মৃতি মনে করে বিলাপ করছিলেন অভাগা মা। আহাজারি করে বলছিলেন, ‘টেবিলে বই, আলনায় কাপড় সবই আছে, নেই শুধু আমার ছেলেটা।’

পড়ার টেবিলে সারি সারি বই রাখা। দেয়ালে টানানো রুটিন, ব্যাগটাও রাখা আছে টেবিলেই। চার্জার লাইট, মার্কার পেন আর ঘড়িটাও রয়েছে টেবিলের তাকে। পাশেই আলনায় রাখা আছে জামাকাপড়। সেগুলোতে এখনো লেগে আছে গায়ের ঘ্রাণ। টেবিলে বসে অপলক তাকিয়ে ছিলেন সদ্য সন্তান হারানো এক বাবা।

সড়কে মদ্যপ চালকের বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় নির্মমভাবে প্রাণ হারানো বুয়েট শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাসুদের (২২) বাড়িতে এখন শুধুই চলছে মাতম আর আহাজারি। বাবা মাসুদ মিয়া এবং মা রাইসা সুলতানা যেন সন্তান হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন।

গতকাল শনিবার মাসুদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরপরই চিৎকার করে কেঁদে উঠছিলেন অভাগা এই বাবা-মা। স্বজন এবং মাসুদের সহপাঠীরা শুধুই জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাদের।

বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল উপশহরে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে বেপরোয়া প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নিহত হন বুয়েট শিক্ষার্থী মাসুদ (২২)। আহত হন নিহতের সহপাঠী অমিত সাহা (২২) ও মেহেদী হাসান (২২)।

তারা তিনজনই বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবারের এ ঘটনার পর শুক্রবার মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় মাসুদকে।

মুহতাসিম মাসুদের মা রাইসা সুলতানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, আমি তো এখন মরার মতো বেঁচে আছি। আল্লাহ আমার ছেলেকে এতটুকু আয়ু দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল। দুর্ঘটনার ঘটনাস্থলে আরও আট থেকে ১০ জন ছিল, দুজন আহত হয়েছে। আমার ছেলেটাই শুধু চলে গেছে। আমার ছেলে এতটুকু হায়াত নিয়া আসছে। আমার সন্তান তো কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না।

আমার সন্তান এত গর্ব করার মতো ছিল, হয়তো ক্ষণজন্মা বলেই এত গর্ব করার মতো ছিল। যেই দেখত, সেই বলত, আপনার ছেলে এত লম্বা, এত সুন্দর। দেখতেও সুন্দর, আচরণেও সুন্দর আমার ছেলে। কেউ কোনো কিছু বললে, শত ব্যস্ততার মাঝেও তার কথাটা গুরুত্ব দিয়ে শুনত। কখনো বিরক্ত হতো না।

বাসায় আসা মাসুদের বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে শুধু চোখের পানি ফেলছিলেন এই অভাগী মা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, তোমাদের বন্ধু তো আর আমার কাছে আসবে না রে। আর কোনোদিন আসবে না।

স্মৃতি হাতড়ে এই মা বলেন, জন্মের পর থেকে এই বুয়েট পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য আমাদের জীবনের যে কত ত্যাগ, কত কষ্ট! আমার সব কষ্ট আল্লাহ নিয়ে গেল। ছেলের স্কুলজীবন থেকে নিজের সঙ্গে রেখে ছেলেকে বড় করেছি। সকালে অফিস করেছি, বিকেলে এসে ছেলেকে কোচিংয়ে নিয়ে গেছি।

আবার রাতে পাশে বসে থেকে পড়িয়েছি, খাইয়ে দিয়েছি। আমার এত কষ্ট, এত ত্যাগ সব আজ শেষ হয়ে গেছে। এই বাসায় আর থাকতে পারব না। এই বাসার প্রতিটি কোণায় আমার ছেলের স্মৃতি। এই মনে হয় আমার ছেলে এসে আমাকে ডাক দেবে। এভাবে তো এখানে বাঁচতে পারব না। এই বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে যাব।

বাবা মাসুদ মিয়া জানান, বুয়েটে কনসার্ট ছিল। সেজন্য আমার মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিল। কথা ছিল ১১টার মধ্যেই চলে আসবে। তার মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় ১১টায়। তখন জানায় অনুষ্ঠান শেষ হয়নি, এজন্য আজ হলে থাকবে। এরপর কনসার্ট শেষ করে দুই বন্ধুকে নিয়ে ৩০০ ফিট যায় খাওয়ার জন্য।

এ সময় রাস্তায় পুলিশ আটকায় কাগজ দেখার জন্য। পুলিশ সদস্যরা মোটরসাইকেলটি রাস্তার পাশে দাঁড় না করিয়ে, রাস্তার মাঝখানেই দাঁড় করায়। যখন কাগজ দেখাচ্ছিল, তখন মদ্যপ অবস্থায় ওই চালক বেপরোয়াভাবে গাড়ি নিয়ে এসে তাদের ওপর তুলে দেয়। মুহতাসিম মাসুদের শুধু মুখ ছাড়া হাত-পায়ের সব হাড় ভেঙে যায়, মেরুদণ্ডের হাড়ও ভেঙে যায়। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যায়।

বাবা মাসুদ মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার জীবনের সব শেষ। আমি কীভাবে বেঁচে থাকব জানি না। সব স্বপ্ন-আশা শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলে হত্যার সর্বোচ্চ বিচার চাই। যারা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে আমার ছেলেকে নির্মমভাবে মেরে ফেলেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই। তারা যেন কোনোভাবেই পার না পেয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমার ছেলেকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করেছি। সরকারের কাছে আমাদের একটা দাবি আছে। সেটি হচ্ছে, কবরের ওই জায়গাটুকু যেন আমার ছেলের জন্যই দেওয়া হয়। বেশি কিছু চাই না, ওই সাড়ে তিন হাত জায়গা নিয়েই বাঁচতে চাই।

এদিকে সহপাঠী নিহত হওয়ার ঘটনায় শনিবার বিক্ষোভ মিছিলে প্রতিবাদমুখর ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ সরকারের কাছে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন তারা। ‘আর নয় প্রাণহানি, সড়ক হতে হবে নিরাপদ’—এই দাবি উঠছে শিক্ষার্থীদের সোচ্চার কণ্ঠে।

শিক্ষার্থীরা বলেন, বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়। বরং চালক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে আমাদের এক সহপাঠীকে হত্যা করেছে এবং দুজনকে গুরুতর আহত করেছে। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

আমরা কোনো ধরনের হুমকি পাইনি; কিন্তু সেটেলমেন্টের চেষ্টা করেছেন উনারা। সেটা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। তারা আরও বলেন, অভিযুক্তদের আইনজীবী গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

এই হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে অপপ্রচারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমরা এই অপপ্রচারের তীব্র নিন্দা জানাই এবং দ্রুত এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাই।’

সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে তারা বলেন, দেশের বিচারব্যবস্থাকে একটি গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করুন; অপরাধী যে পরিবারেরই সদস্য হোক না কেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, এ ব্যাপারটি ফের প্রতিষ্ঠিত হোক।

হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার অবশ্যই বিবাদীপক্ষকে বহন করতে হবে এবং নিহতের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরো খবর