রাষ্ট্র হলো একটি যন্ত্র যা আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি জাতির সামগ্রিক অধিকার সংরক্ষণ ও শৃঙ্খলা রক্ষা করে, জাতির উন্নয়নে কাজ করে। দীর্ঘদিনের বিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানা শক্তি ও উপাদান ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে হতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে অবদান রেখেছে কিছু উপাদান, যেমন ধর্মীয় বন্ধন, সংস্কৃতির বন্ধন, রক্তের বন্ধন, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা ও কার্যকলাপ।
আইন প্রণয়ন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ। রাষ্ট্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইন প্রণীত হয়, আর দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট প্রভৃতি বিচারালয়ের মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
তবে, যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়, তখন রাষ্ট্রের কাঠামো দুর্বল হতে শুরু করে এবং মানুষ আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হয়। তখনই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা, অশান্তি ও অরাজকতা। রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত এর কুফল ভোগ করতে থাকে, এবং কেউই এর থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তাই আমাদের সকলকেই রাষ্ট্রের কাঠামো সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের রাষ্ট্র কাঠামো অনেকটা ভেঙে পড়েছে, তাই সংস্কারের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই সংস্কারের ক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক কাঠামোগুলোর দিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। এসব মৌলিক কাঠামো দুর্বল হলে রাষ্ট্রও দুর্বল হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক কাঠামো কী কী হতে পারে এবং কী ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন, তা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর সার্বজনীন সংবিধান, পবিত্র কুরআনে, আগে থেকেই লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর বাণীতে বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا (সুরা নিসা, আয়াত: ৫৮)
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তাদের হকদারদের আদায় করে দিবে, আর যখন মানুষদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফ বা ন্যায় বিচারের সাথে বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে যে বিষয়ে উপদেশ দিয়ে থাকেন, তা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা।
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক কিছু উপাদান উল্লেখ করেছেন। যেগুলো যথাযথ সংরক্ষণে একটি রাষ্ট্র উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে, আবার এই উপাদানগুলো হারালে রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে পারে।
এ আয়াতের প্রথম নির্দেশনা হলো ‘আমানতদারিতা’, যা একটি সফল রাষ্ট্র গঠনের প্রথম উপাদান। যখন একটি রাষ্ট্রে আমানতদারিতার অভাব দেখা দেয়, তখন রাষ্ট্র সার্বিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের সব স্তরে ওয়ার্ড কাউন্সিল থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত আমানতদারিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামি খিলাফতের সময় শান্তি ও সমৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ ছিল খলিফাদের আমানতদারিতা। ৯৯ হিজরিতে ইসলামের প্রসিদ্ধ খলিফা, ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ.খলিফার দায়িত্ব গ্রহণের পর, একান্ত কামরায় বসে আছেন আর তার চক্ষু বেয়ে পানি ঝরছে । তাঁর স্ত্রী ফাতিমা বিনতে আব্দুল মালিক তাঁকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেছিলেন, ‘আমি রাষ্ট্রের খলিফা নিযুক্ত হয়েছি, তাই আমি আমার রাষ্ট্রের অধীনস্থ অসহায়, দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীন, বৃদ্ধ, অনাথদের কথা ভাবছি, কেননা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন’।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই একজন জিম্মাদার (দায়িত্বশীল), এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জাতির ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান) একজন জিম্মাদার, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পরিবারগুলোর কর্তা, তাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে জিম্মাদার, এবং এমনকি একজন খাদেমও তার মালিকের সম্পদের জিম্মাদার হিসেবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
এছাড়া, সহিহ ইবনে হাব্বান-এ বর্ণিত হয়েছে, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,‘কিয়ামতের দিন তোমাদের প্রত্যেককে তার দেওয়া দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, সে কি সেটা যথাযথ পালন করেছে, না তা নষ্ট করেছে। এমনকি পরিবারগুলোর অভিভাবকদের তাদের পরিবারস্থ ব্যক্তিদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’।
অতএব, রাষ্ট্রের প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে এবং আমানতদার হয়, তবে একটি রাষ্ট্র অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে ও সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারে।
এ জন্য আমাদের রাষ্ট্র গঠন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে আমানতদারিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও উন্নতির মূল চাবিকাঠি।
লেখক: নাজমুল আরিফীন বিন মুহাম্মদ
শিক্ষার্থী: আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো মিশর