রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫
৪ মাঘ, ১৪৩১

পরিক্ষামূলক সংস্করণ

ইসলাম ও জীবন

স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি আলেমদের অমূল্য অবদান

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশঃ ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:৩৭

স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি আলেমদের অমূল্য অবদান

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় সংগ্রাম। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াইয়ে কেবল সাধারণ মানুষ নয়, দেশের আলেম সমাজও ছিল অগ্রভাগে। তাদের অংশগ্রহণ ছিল একাধিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার পর মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান ছিল সঙ্গতি ও সংগ্রামের নিদর্শন।

স্বাধীনতা অর্জনে আলেমরা যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা আজও আমাদের প্রেরণা যোগায়। আজ আমরা তাদের সম্পর্কে জানবো ইনশাআল্লাহ ।

১. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সঙ্গী ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে তিনি সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জনমত গঠনে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন।

২. হাফেজ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন হাফেজে কুরআন। তিনি যুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেন এবং দেশ মুক্তির লক্ষ্যে এক অগ্রণী নেতা হিসেবে কাজ করেন।

৩. শহীদ আলেম বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী একজন আলেম ছিলেন মাওলানা অলিউর রহমান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পুস্তিকা রচনা করতেন। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ তার অকাল শহীদ হন আলবদর বাহিনীর হাতে।

৪. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আলেমরা
মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ ও মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী দুই ভাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কুরআনভিত্তিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এবং জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সচেতন করেন।

৫. যোদ্ধা সংগ্রাহক মুফতি আব্দুস সোবহান
চট্টগ্রামের মুফতি আব্দুস সোবহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ প্রদান করেন। তিনি নিজে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন এবং তরুণদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন।

৬. গেরিলা যোদ্ধা মাওলানা আবদুর রহমান
কুমিল্লার মাওলানা আবদুর রহমান ছিলেন একজন গেরিলা যোদ্ধা। তিনি যুদ্ধের শুরুতে প্রশিক্ষণ নিয়ে একাধিক গেরিলা অভিযানে অংশ নেন ও দেশ স্বাধীন করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

৭. লিফলেট বিতরণকারী মাওলানা আবু ইসহাক
রাঙামাটির মাওলানা আবু ইসহাক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণ করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনগণকে জাগ্রত করতেন। রাজাকার বাহিনী তাকে খুঁজতে শুরু করলে তিনি গভীর জঙ্গলে আত্মগোপন করেন।

৮. মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের অংশগ্রহণকারী মাওলানা আবদুস সোবহান
মাওলানা আবদুস সোবহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ গঠন করেন এবং তার নেতৃত্বে শতাধিক যোদ্ধা সংগ্রহ করা হয়।

৯. মাওলানা দলিলুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রাম
মাওলানা দলিলুর রহমান রাঙ্গুনিয়ায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই আলেম সমাজকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

১০. মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সেনা কর্মকর্তা মাওলানা নূরুল আফসার
মাওলানা নূরুল আফসার ফেনী ও নাজিরহাট অঞ্চলের একাধিক মুক্তিযুদ্ধের অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং পরে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে সার্জেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করেন।

১১. মসজিদে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দানকারী মাওলানা মতিউল ইসলাম
নারায়ণগঞ্জের মিলনপাড়া মসজিদের ইমাম মাওলানা মতিউল ইসলাম যুদ্ধকালীন সময়ে মসজিদে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে তাদের সুরক্ষা প্রদান করেন।

১২. সংবাদ সংগ্রহকারী মাওলানা মির্জা মোহাম্মদ নূরুল হক
কুড়িগ্রামের মাওলানা মির্জা মোহাম্মদ নূরুল হক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংবাদ সংগ্রহ করতেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করতেন।

১৩. তিস্তা ব্রিজ দখলকারী মাওলানা আমজাদ হোসেন
মাওলানা আমজাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তিস্তা ব্রিজ অপারেশনে অংশ নিয়ে দীর্ঘ ১৩ দিন যুদ্ধ করে ব্রিজটি দখল করেন।

১৪. প্রকাশ্যে জীবন উৎসর্গকারী মাওলানা আবুল হাসান
মাওলানা আবুল হাসান যশোর রেলস্টেশন মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন এবং পাকিস্তানি বাহিনী তার মাদরাসায় হামলা চালিয়ে তাকে শহীদ করে। তার আত্মত্যাগ দেশের স্বাধীনতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এইসব আলেমরা শুধুমাত্র ধর্মীয় নেতাই ছিলেন না, বরং তারা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে দেশকে স্বাধীন করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করেন। তারা দেশে এবং বিদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাদের অবদান আজও বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের এই সাহসিকতা ও ত্যাগকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত, কেননা তারা প্রমাণ করেছেন, ধর্ম, জাতি, ও স্বাধীনতার সংগ্রামে কখনো কোনো বিভেদ হতে পারে না, বরং একসঙ্গে এগিয়ে চলা ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়।

এ সম্পর্কিত আরো খবর