সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫
২৮ পৌষ, ১৪৩১

পরিক্ষামূলক সংস্করণ

ইসলাম ও জীবন

নবীজি সা. কীভাবে বিজয় উদযাপন করেছিলেন?

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশঃ ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:০৩

নবীজি সা. কীভাবে বিজয় উদযাপন করেছিলেন?

মাতৃভূমি শুধু একটি ভৌগোলিক সীমানা নয়, বরং তা আমাদের অস্তিত্বের মূল। যেখানে আমরা জন্মগ্রহণ করি, যেখানে আমাদের শৈশব কাটে, যেখানে আমাদের স্মৃতিগুলি জড়িত থাকে, সেই স্থানকেই আমরা মাতৃভূমি বলি। মাতৃভূমি প্রেম মানুষের স্বাভাবিক একটি অনুভূতি। যা আমাদের পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ইতিহাস জুড়ে দেখা যায়, মানুষ মাতৃভূমির জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে মাতৃভূমির জন্য মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে। কুরআনুল কারিমেও বিজয়ের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। মাতৃভূমি প্রেম শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; মানবিক মূল্যবোধেরও একটি অংশ।

আজকের বিশ্বায়নের যুগে যখন মানুষ সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, তখনও মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা অবিরাম। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রমাণ দিয়েছেন প্রিয় নবীজি সা.। যেদিন তিনি মক্কা বিজয় করলেন শুকরিয়া নামাজ আদায় করলেন।

শুধু তাই নয়, কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বিজয় শিরোনামে নাসর ও ফাতহ নামের দুটি সুরা নাজিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্যে বিজয় আসবে, তখন মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবে। তখন তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করো। আর তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল’ (সুরা নাসর, আয়াত ১-৩)

পবিত্র কুরআনুল কারিমের এ সুরায় মহান আল্লাহ বিজয় উদযাপনের দুইটি পদ্ধতি নবীজিকে শিখিয়ে দিয়েছেন। এক. আল্লাহর প্রশংসায় তার পবিত্রতা বর্ণনা করা। দুই. যুদ্ধকালীন অজান্তে যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে, তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা (বিজয়) দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত দান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে (সুরা হজ, আয়াত ২২)।

নবীজি আল্লাহর দেয়া পদ্ধতিতে মক্কা বিজয় উদযাপন করলেন। বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মক্কা বিজয়ে নবীজি আনন্দে সর্বপ্রথম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।

আট রাকাত শুকরিয়ার নামাজ আদায় করে আনন্দ প্রকাশ করেন (জাদুল মায়াদ, আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওজি)। নবীজির দেখাদেখি অনেক সাহাবিও তার অনুকরণে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন।

এ আনন্দ উদযাপন ছিলো দশম হিজরিতে। যে দিন মক্কা বিজয় হয়। মহানবী সা. প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতায় তিনি এত বেশি খুশি হয়েছিলেন, খুশিতে মহান রবের দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। বিজয়ের আনন্দে তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘যারা কাবাঘরে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ।

এভাবে মক্কার সম্ভ্রান্ত কয়েকটি পরিবারের ঘরে যারা আশ্রয় নেবে, তারা যত অত্যাচার-নির্যাতনকারীই হোক না কেন তারাও নিরাপদ। এই ছিল প্রিয়নবীর মক্কা বিজয়ের আনন্দ উৎসবের ঘোষণা।

দেশপ্রেম ভালোবাসায় নবীজি বলেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে, তার রিজিক অব্যাহত থাকবে, কবর-হাশরের ফিতনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে।’ (মুসলিম ১৯১৩)

নিজের শহর মক্কা ছেড়ে মদিনায় যাওয়ার পর নবীজির দেশপ্রেম বুঝা গিয়েছিলো। তিনি প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। হে আল্লাহ! আমার কাছে মক্কা যতোটা প্রিয় ছিল, এর চেয়ে বেশি প্রিয় আমার কাছে মদিনাকে বানিয়ে দাও। (ইবনে হিব্বান ৫৬০০)

মদিনা নিজের দেশ বানানোর পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনি মদিনার বাহির থেকে মদিনার দিকে ফিরে আসতেন। তখন নবীজি কী করতেন? এক হাদিসে আসছে,

হযরত হুমায়দ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি আনাস রা. কে বলতে শুনেছেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর থেকে ফিরে যখন মদিনার উঁচু রাস্তাগুলো দেখতেন তখন তিনি তার উটনীকে মদিনার মুহব্বতে দ্রুতগতিতে চালাতেন তার বাহন অন্য জানোয়ার হলে তিনি তাকে তাড়া দিতেন। (বুখারি ১৮০২ ১৬৮৫)

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ বলেন, এ হাদিস মদিনার ফজিলতের সাথে সাথে নিজের দেশকে মুহাব্বত করা ও তার প্রতি টান অনুভব করার বৈধতার প্রমাণও বহন করে। (ফাতহুল বারি-৩/৬২১, ১৮০২)

ইবনে বাত্তাল রহ. লিখেন, মদিনার মুহাব্বতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়ারী দ্রুতগামী করার কারণ হলো, কেননা, এটি তার দেশ।

এতে তার পরিবার পরিজন ছিলেন। যারা লোকদের মাঝে তার কাছে সর্বাধিক প্রিয় ছিল। স্বীয় দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং আন্তরিক টান অনুভব করা আল্লাহ তাআলা স্বভাবজাত বানিয়েছেন। যেমনটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও করেছেন। যাতে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রয়োজনীয় সফর শেষ হবার পর স্বীয় পরিবারের কাছে দ্রুত ফিরে আসার আদেশ করেছেন। (শরহে বুখারি লিইবনে বাত্তাল-৪/৪৫৩)

নিজের মাতৃভূমি বা স্বীয় দেশকে মুহাব্বত করা, ভালোবাসা, তার প্রতি আন্তরিক টান অনুভব করা স্বভাবজাত বিষয়। রসুল সা. নিজের দেশকে ভালোবেসেছেন। দেশপ্রেম একটি সুন্নাহ।

মক্কা বিজয়ের দিন উটনির পিঠে সওয়ার হয়ে আনসার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত অবস্থায় রসুলুল্লাহ সা. মক্কায় প্রবেশ করেন। এদিন তিনি আল্লাহর প্রতি বিনয়ী ও তার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়কারী হিসাবে মক্কায় প্রবেশ করেন।

বিজয়ী সেনাপতির ন্যায় অহংকারীভাবে নয়। এ সময় তিনি সওয়ারির উপরে বসে সুরা ফাতহ বা তার কিছু অংশ ধীর কণ্ঠে বারবার পাঠ করছিলেন’ (বুখারি ৪২৮১, ৫০৪৭)।

তিনি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন, হাতের মাথা বাঁকানো লাঠির মাধ্যমে হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন। বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেন।

এ সময় কাবাগৃহের ভিতরে ও বাইরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। রসুলুল্লাহ সা. হাতের লাঠি দিয়ে এগুলি ভাঙতে থাকেন। কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পড়তে থাকেন। ‘তুমি বল, হক এসে গেছে, বাতিল দূরীভূত হয়েছে। নিশ্চয়ই বাতিল দূরীভূত হয়েই থাকে’ (বনু ইসরাঈল ৮১)।

তিনি আরও পড়েন,‘তুমি বল হক এসে গেছে এবং বাতিল আর না শুরু হবে, না ফিরে আসবে’ (সুরা সাবা ৪৯)। অর্থাৎ সত্যের মুকাবিলায় মিথ্যা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয় যে, তা কোন বিষয়ের সূচনা বা পুনরাবৃত্তির যোগ্য থাকে না’ (বুখারি ৪২৮৭)।

আমরা যদি নবীজির মতো আমাদের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করি, তবে তা শুধু আমাদের জীবনকে সার্থক করবে না, বরং সমাজ ও জাতির কল্যাণেরও পথ প্রশস্ত করবে।

তাই, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করা, শুধু একটি ধর্মীয় কর্তব্যই নয়, বরং মানবিক ও জাতীয় কর্তব্য হিসেবেও অপরিহার্য।

এ সম্পর্কিত আরো খবর