ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সংসদ সদস্য টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক বর্তমানে বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি ঢাকার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এরই মধ্যে তার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নথিপত্র ঘিরেও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
২০১৭ সালে এক সাংবাদিকের প্রশ্নে টিউলিপ বলেছিলেন,
“আমি বাংলাদেশি নই, আমি একজন ব্রিটিশ এমপি।” তবে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক বাংলাদেশের একজন নাগরিক এবং ভোটার। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), পাসপোর্ট এবং আয়কর রিটার্ন—সবকিছুই তার বাংলাদেশি নাগরিকত্বের প্রমাণ বহন করে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানায়, তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ৫০৬৬……৮, যা ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি ইস্যু করা হয়। তথ্য অনুযায়ী, তার পিতার নাম শফিক আহমেদ সিদ্দিক এবং মায়ের নাম রেহানা সিদ্দিক। ঠিকানা হিসেবে দেওয়া হয়েছে ধানমণ্ডির সুধাসদন, যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনের ঠিকানা হিসেবে পরিচিত।
এনআইডি ছাড়াও টিউলিপ নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, যার ভোটার নম্বর ২৬১৩……৯ (হালনাগাদ ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪)। তাছাড়া তার নামে একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে। প্রথম পাসপোর্ট ২০০১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য থেকে ইস্যু হয়, যেখানে জন্মস্থান ও পাসপোর্ট ইস্যু স্থানে উল্লেখ রয়েছে: লন্ডন, ইউকে। ২০১১ সালে এই পাসপোর্ট নবায়ন করে নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেন, যার ইস্যু স্থান ছিল বাংলাদেশের আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস। জরুরি যোগাযোগ ঠিকানায় দেওয়া ছিল তার চাচা তারেক আহমেদ সিদ্দিকের নাম, যিনি শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে শুরু হয় তার শাসনামলের বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্ত। এরই অংশ হিসেবে দুদক টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে মামলা করে, যা বর্তমানে বিচারাধীন। মামলার ভিত্তিতে সম্প্রতি একটি আদালত টিউলিপ সিদ্দিকসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
উল্লেখ্য, টিউলিপ বর্তমানে যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট আসনের সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৫ সাল থেকে টানা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন এবং ছিলেন লেবার সরকারের সিটি মিনিস্টার (অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সচিব)। তবে বাংলাদেশে মামলা শুরুর পর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি নিজে থেকেই পদত্যাগ করেন, যাতে ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত না করতে হয়।
লন্ডনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টিউলিপ বলেন,
“বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তারা প্রথম থেকেই আমাকে মিডিয়া ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে দোষী বানাতে চেয়েছে। আমার আইনজীবীরা তাদের কাছে চিঠি পাঠালেও তারা কোনো উত্তর দেয়নি।”
তিনি আরও বলেন,
“এই অপপ্রচার একেবারেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই যে আমি আইন ভেঙেছি বা অন্যায় করেছি। এই পুরো বিষয়টা আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য সাজানো হয়েছে।”
এই ঘটনা ঘিরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোড়ন তৈরি হয়েছে। একদিকে, যুক্তরাজ্যে একজন নির্বাচিত সাংসদের বিরুদ্ধে নিজের জন্মভূমিতে দুর্নীতির অভিযোগ; অন্যদিকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাচ্যুত সরকার সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া—দুটি বিষয়ই সমান্তরালভাবে আলোচনায় রয়েছে।
এখন দেখার বিষয়, টিউলিপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালত কীভাবে কার্যক্রম এগিয়ে নেয়, এবং যুক্তরাজ্য থেকে কোনো সহযোগিতা আদায় সম্ভব হয় কি না—যেহেতু দুই দেশের মধ্যে এখনো প্রত্যর্পণ চুক্তি (Extradition Treaty) নেই। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মামলা একদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বার্তা দিতে পারে, আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন এক জটিলতা তৈরি করতেও পারে।

দুই বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, প্রতিবাদে দুই ভারতীয়কে ধরে এনেছে গ্রামবাসী। এব্যাপারে আপনার মতামত কি?