গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর ইসরায়েলের অব্যাহত বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণে মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গাজা সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, শুধু গত কয়েক দিনের হামলায় অন্তত ৫০০ শিশু নিহত হয়েছে।
সংঘাত শুরুর পর থেকে গাজা ক্রমশ পরিণত হয়েছে এক মৃত্যুপুরীতে। চিকিৎসা, খাদ্য, জ্বালানি ও নিরাপত্তার মতো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত লাখো মানুষ অনাহার, দুঃসহ মানসিক অবস্থা এবং জীবনরক্ষার সংগ্রামে দিন কাটাচ্ছে। শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ছে ক্ষুধার্ত অবস্থায়, আর কেউ কেউ জীবন হারাচ্ছে মায়ের কোলেই।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ১৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েল মোট ২২৪টি হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ৩৬টি হামলায় কেবলমাত্র নারী ও শিশুরাই নিহত হয়েছেন। এই হামলাগুলোতে লক্ষ্যবস্তু ছিল মূলত আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল সংলগ্ন অঞ্চল এবং জাতিসংঘ পরিচালিত মানবিক সহায়তা কেন্দ্র।
ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থা আল-হক এক বিবৃতিতে জানায়, “নারী, শিশু, এমনকি নবজাতকদের নির্মূল করার মতো প্রচেষ্টা আধুনিক কোনো যুদ্ধে দেখা যায়নি।” তারা এই অবস্থাকে স্পষ্টত গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে।
ইউএনআরডব্লিউএ’র প্রধান ফিলিপ লাজারিনি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বলেন, “ইসরায়েল গাজায় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ সরবরাহে বাধা দিচ্ছে, যা স্পষ্টত যুদ্ধাপরাধ।” শনিবার এক্স-এ (সাবেক টুইটার) ইউএনআরডব্লিউএ’র যোগাযোগ পরিচালক জুলিয়েট তোমা বলেন, “গাজায় মৌলিক প্রয়োজনীয় সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। শিশুদেরকে খালি পেটে ঘুমাতে হচ্ছে। মানুষ এখন খাবারের পরিবর্তে ঘাস ও পশুখাদ্য খাচ্ছে।”
এই পরিস্থিতিতে আল-আকসা হাসপাতালসহ গাজার বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে চলছে চরম মানবিক সংকট। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে আহত নারী ও শিশুরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছেন না। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্সে আসা অধিকাংশ আহতই শিশু ও নারী, যাদের অনেকেই গুরুতর অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে তারা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ও প্রতিবেদনগুলোতে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে শিশুদের মরদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে। পিতামাতারা সন্তান হারানোর বেদনায় ভেঙে পড়ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এমনকি জাতিসংঘের রিফিউজি ক্যাম্প পর্যন্ত হামলার শিকার হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।
এদিকে ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ গাজায় নতুন করে “দখল অভিযানের পরিকল্পনা” নিচ্ছে। গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনুস ও রাফাহ অঞ্চলে ইতিমধ্যেই ট্যাংক ও সামরিক যান মোতায়েন করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই ঘটনার বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরও সরব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনজীবী ও যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হামলাগুলো একটি জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগঠিত সহিংস নির্মূল প্রচেষ্টার সুস্পষ্ট নিদর্শন বহন করে।
এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ, আইসিসি (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত), রেড ক্রসসহ বিভিন্ন সংস্থা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার দাবি করছে। তবে এখনও পর্যন্ত বড় পরিসরে কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত মেলেনি।
গাজাবাসীরা এখন কেবল অস্ত্রবিরতি নয়, মানবতার এক ফোঁটা সাড়া পাওয়ার আশায় পৃথিবীর বাকি অংশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে নীরবতা এবং আরব বিশ্বের নির্লিপ্ততা এ সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে। আর প্রতিটি দিনই যেন এক নির্মম গণশোকের গল্প হয়ে উঠছে গাজার আকাশে।

জয় ও নিঝুম মজুমদারের এই আহ্বানকে দেশবিরোধী বলে মনে করেন ?