ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যে কোনও আক্রমণের তাৎক্ষণিক এবং চূড়ান্ত জবাব দেওয়া হবে। তিনি বলেছেন: “আমেরিকা এবং ইসরাইল পাগল হয়ে গেছে। যদি তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করে, তবে এটি হবে এই অঞ্চলের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়।”
মঙ্গলবার সম্প্রচারিত ব্রিটেনের স্কাই নিউজ চ্যানেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাকচি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি এবং সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরেছেন। পার্সটুডের এই প্রতিবেদনে এই সাক্ষাতকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: আপনি খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং স্পর্শকাতর সময়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ অঞ্চল বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে। হোয়াইট হাউসে যিনি এখন আছেন তিনি ইরানের শত্রু। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন ইরানের সাথে একটি চুক্তি করার কথা বলছেন। তাই এখানে হুমকি এবং সুযোগ দুটোই আছে। আপনি কি এমন কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন যে ইরান ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কোন ধরণের চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক হবে?
উত্তর: ইরানের নতুন সরকার তার পররাষ্ট্র নীতি কার্যকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য চেষ্টা করছে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে যা আপনি জানেন। সুতরাং এর অর্থ হল আমরা বিশ্বের সব দেশের সাথে যোগাযোগ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে প্রস্তুত। দুর্ভাগ্যবশত, যখন আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন এই অঞ্চলটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ছিল। আমার মূল লক্ষ্য ছিল আঞ্চলিক যুদ্ধ সংঘাত প্রতিরোধ করা এবং এমন পদক্ষেপ নেয়া যাতে সমগ্র এ অঞ্চলকে উত্তেজনা ও সংঘাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। আমি এই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি দেশেই গিয়েছি যাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে, এমনকি মিশর এবং বাহরাইনেও গিয়েছি, যাদের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। আমি কিছু বিষয়ে অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি যাতে উত্তেজনা রোধ করা যায়। আমার মনে হয় আমি সফল হয়েছি।
একই সাথে, আমি ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে নতুন করে একটি চুক্তিতে পৌঁছার চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি ও অবিশ্বাস দূর করার জন্য একটি নতুন উপায় খুঁজে বের করতে, পরমাণু সমঝোতা জেসিপিওএ-তে ফিরে যেতে চাই, অথবা অন্তত এই ক্ষেত্রে আমরা কীভাবে একটি নতুন সমাধান খুঁজে পেতে পারি তা খতিয়ে দেখতে সম্মত আছি। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর, আমরা এখনও নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি কী হবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। আমাদের পরমাণু কর্মসূচিতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। মার্কিন সরকার ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় তাকেই এ বিষয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। তাই আমরা মার্কিন সরকার কি পদক্ষেপ নেয় সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু কোনো হুমকিকে আমরা পরোয়া করি না।
আমরা অতীতেও এটা প্রমাণ করেছি যে কেউ সম্মান ও শ্রদ্ধার ভাষায় কথা বললে আমরা সাড়া দেই। এই নীতিতে আমরা এখনো অটল রয়েছি। একই সাথে, আমাদের আরো কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেমন তারা যখন আমাদের হুমকি দিয়েছিল, তারা যখন আমাদের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তখন এর ফলাফল কী হয়েছিল? আমরা এখন আমাদের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমরা এখন আমাদের প্রতিরক্ষা শিল্পেও অনেক বেশি এগিয়ে। কেন? কারণ তারা আমাদের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল এবং সেটাকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়ে আমরা সামরিক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছি। সুতরাং তাদের নিষেধাজ্ঞা কোনো কাজে আসেনি।
প্রশ্ন: এবার ইসরাইল প্রসঙ্গে আসা যাক। কারণ আমার মনে হয় ইসরাইলের কাছ থেকে ইরানের জন্য হুমকি আছে। আমরা ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি যে ইরানকে আক্রমণ করার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর কখনও আসেনি কারণ ইরান সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলেছেন যে, যদি কোনও চুক্তিতে পৌঁছানো না যায়, তাহলে তিনি ইরানে হামলার বিষয়ে ইসরাইলকে সমর্থন করতে প্রস্তুত। এই আশঙ্কা নিয়ে আপনি কতটা চিন্তিত?
উত্তর: তারা জানে যে এটি প্রকৃত হুমকি নয়, কারণ তারা আমাদের পক্ষ থেকে কি ধরণের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে সে সম্পর্কে ভাল করেই জানে। আমরা স্পষ্ট করে দিয়েছি যে আমাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যেকোনো আক্রমণের তাৎক্ষণিক এবং চূড়ান্ত জবাব দেয়া হবে। তাই আমার মনে হয় না তারা এমন পাগলামি করবে। কিন্তু তারা যদি সত্যিই পাগলামি করে বসে তাহলে সমগ্র এই অঞ্চল বড় বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবে। আমি এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। কেন? কারণ আমি মনে করি এসব হুমকি অবাস্তব এবং লোক দেখানো।
প্রশ্ন: এবারে ইসরাইল, ফিলিস্তিন এবং গাজা সম্পর্কে কথা বলা যাক। ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি গাজার ফিলিস্তিনিদেরকে অন্য দেশে পাঠিয়ে গাজাকে সাফ করা অর্থাৎ এ অঞ্চলকে সম্পূর্ণ খালি করে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা কি ইরানের জন্য রেড লাইন নয়? যদি এমনটা ঘটে তাহলে ইরান কি ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাবে?
উত্তর: ভুলে গেলে চলবে না যে শেষ পর্যন্ত ইসরাইলিরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হয়েছিল যে তাদের হামাসের সাথে আলোচনা করতে হবে। তারা হামাসকে ধ্বংস করার জন্য সেখানে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বন্দীদের মুক্তির জন্য হামাসের সাথে আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছিল। তাই আমার পরামর্শ অন্য কিছু। ফিলিস্তিনিদের পরিবর্তে, তাদের উচিত ইসরাইলিদের বিতাড়িত করার চেষ্টা করা। এক ঢিলে দুই পাখি মারতে ওদের গ্রিনল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। যাতে গ্রিনল্যান্ডের সমস্যা সমাধানও হয় এবং ইসরাইলিরাও সেখানে থাকতে পারে।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় ইসরাইলের তাদের ভূমিতে বসবাসের অধিকার আছে?
উত্তর: সবারই বেঁচে থাকার অধিকার আছে, কিন্তু অন্যের জমি দখল করার অধিকার কারোরই নেই। এটি ফিলিস্তিনিদের ভূমি এবং ফিলিস্তিনিদেরই তাদের ভূমি এবং তাদের ভাগ্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রশ্ন: গত এক বছরে, আমরা হিজবুল্লাহর দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যু (শাহাদাত) প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও দেখেছি। আমরা আপনাদের মিত্র বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঘটনাও দেখেছি। তাহলে এটা কি বলা যায় যে আপনাদের কৌশল আর কাজ করছে না?
উত্তর: আমাদের জানা উচিত যে প্রতিরোধ একটি চিন্তাধারা এবং একটি আদর্শ। মানুষ হত্যা করলে এই আদর্শ অদৃশ্য হয়ে যায় না। এটা ঠিক যে হামাস এবং হিজবুল্লাহ অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং এখন তারা নিজেদেরকে ফের পুনর্গঠন করছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই চিন্তাধারা এবং এই আদর্শ বিলুপ্ত হবে না।
আমি আপনাকে একটি উদাহরণ দিতে চাই; ফরাসি বিপ্লবকে ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক চিন্তা ও আদর্শের জননী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু পরে কীভাবে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল তা লক্ষ্য করুন। নেপোলিয়নের প্রত্যাবর্তন ঘটে, একনায়কতন্ত্র ফিরে আসে কিন্তু তারপরও ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে উদ্ভূত আদর্শগুলো এখনও পশ্চিমা দেশগুলোতে বিদ্যমান। বলা যায় এই আদর্শ বিভিন্ন রূপ ধারণ করলেও, মূল ধারণাটি এখনও রয়ে গেছে। ঠিক তেমনি এটি এ অঞ্চলের প্রতিরোধ শক্তিগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং তাদের উত্থান-পতন স্বাভাবিক।
গত এক বছরে প্রতিরোধ অনেক ক্ষেত্রে জয়লাভ করেছে। ব্যর্থতা স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিজেকে পুনর্গঠন করা এবং নিজের পথে অটল থেকে এগিয়ে যাওয়া। জনগণ হামাস এবং হিজবুল্লাহকে সমর্থন অব্যাহত রাখবে, তাদের আগের ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে যাতে তারা আগের মতোই ইসরাইলকে প্রতিহত করতে পারে। হামাস এবং হিজবুল্লাহ স্বাধীন এবং তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সর্বদা সমর্থন করেছি এবং করব। যদি তারা ইরানের কাছে সহায়তা চায়, আমরা অবশ্যই তাদের ইতিবাচক সাড়া দেব।
সূত্রঃ পার্সটুডে

জয় ও নিঝুম মজুমদারের এই আহ্বানকে দেশবিরোধী বলে মনে করেন ?