কুমিল্লা প্রতিনিধি
জুলাই-আগষ্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশ সুপারের বদলির আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুরনো কর্মস্থলে অন্তত চার মাস ধরে অবস্থান করার অভিযোগ উঠেছে দাউদকান্দি মডেল থানার এসআই এনামুলের বিরুদ্ধে। নিজ জেলা ও দাউদকান্দি মডেল থানার পার্শ্ববর্তী তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোক হওয়ায় বদলিকৃত এই অফিসারকে না ছাড়ার পিছনে সরাসরি জড়িত রয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জুনায়েত চৌধুরী নিজেই। সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে গত ৩ জানুয়ারি টাইমস নিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও পুরনো কর্মস্থল ছাড়েননি অভিযুক্ত এই দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তা। উল্টো এই দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তাকে রক্ষা করতে সাংবাদিককে বার বার ম্যানেজ করতে ঘুষ দেওয়ার সরাসরি চেষ্টা করেছেন ওসি জুনায়েত চৌধুরী।
গত ৩ জানুয়ারি নিউজ প্রকাশিত হওয়ার পর রহস্যময়ভাবে সেই পুলিশ কর্মকর্তারকে না ছেড়ে উল্টো ৩ দিনের ছুটিতে পাঠান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এ নিয়ে ১১ জানুয়ারি (শনিবার) সরাসরি কথা বলতে আমরা মুখোমুখি হয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জুনায়েত চৌধুরীর। এ সময় দুই-তিন দিনের মধ্যে অভিযুক্ত সেই পুলিশ অফিসারকে ছেড়ে দিবেন বলে ১ম দফায় নিজ অফিসে বসে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সাংবাদিককে ৩,০০০/- (তিন হাজার) টাকা ঘুষ দিতে চেষ্টা করেন সেই ওসি। কিছুদিন পরে (গত শুক্রবার) ২য় দফায় সাংবাদিককে ম্যানেজ করতে আবারো চেষ্টা করেন থানার ওসি জানায়েত চৌধুরী। এজন্য দাউদকান্দি থেকে অন্তত ৫০ কিলোমিটার অদূরে অবস্থিত কুমিল্লা নগরীতে টাইমস নিউজের অফিসে পাঠান পুলিশের আরেক এসআইকে। আগত সেই পুলিশ অফিসার এ সময় সাংবাদিককে ১০,০০০/- (দশ হাজার) টাকা ঘুষ দিতে চেষ্টা করেন এবং বিষফোরক মন্তব্য করেন তিনি নানা বিষয়ে।
জুলাই-আগষ্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ০৯ অক্টোবর- ২০২৪ তারিখে কুমিল্লার পুলিশ সুপার একটি বদলির আদেশ দেন। সেখানে এসআই এনামুলকে দাউদকান্দি মডেল থানা থেকে লালমাই থানাধীন ভূচ্চি পুলিশ ফাঁড়িতে বদলির আদেশ দেন। কর্মজীবনে নানান ধরণের অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে পত্রিকার পাতার হেডলাইন হয়েছেন বহুবার দাপুটে এই পুলিশ কর্মকর্তা। তবুও থেমে নেই তার অপকর্মের চাকা। এসআই এনামুল হক ২০১৩খ্রিঃ থেকে ২০১৫ খ্রিঃ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন টানা দাউদকান্দি মডেল থানাধীন গৌরীপুর পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে তৎকালিন সময়ে অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা রেঞ্জে বদলি হন তিনি। কিন্তু রহস্যময়ভাবে তিনি সেখান থেকে মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে আবারও বদলি হন কুমিল্লায়। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারও জড়িয়ে পড়েন নানান ধরণের অপরাধে। ফলে আবারও তাকে অভিযোগের ভিত্তিতে বদলি করা হয় নৌ-পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে।
তারপর পুলিশের হেডকোয়ার্টার এর নির্দেশে কুমিল্লা জেলা ব্যতীত অন্য জেলায় বদলি হতে পারবে মর্মে তাকে চট্টগ্রাম রেঞ্জে বদলি করা হয়। পরে তিনি নামমাত্র লক্ষীপুর জেলায় বদলি হলেও রহস্যজনকভাবে ১ মাসের ব্যবধানে তৎকালিন সময়ে দাউদকান্দি মডেল থানার ওসি মোজাম্মেল হক (বর্তমান কর্মস্থল দাউদকান্দির পার্শ্ববর্তী জেলা চাঁদপুরের একটি নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে) এর ইচ্ছেতে ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজিকে হাত করে আবারও বদলি হন কুমিল্লায়। এরপর ২০২৩ সালের শেষ দিকে তৎকালিন পুলিশ সুপার আব্দল মান্নানকে ম্যানেজ করতে সরাসরি ওসি মোজাম্মেল তদবির করেন তাকে দাউদকান্দি মডেল থানায় পদায়নের জন্য। পরে তিনি সে সময় আবারও যোগ দেন পুরনো কর্মস্থল দাউদকান্দি মডেল থানায়। এরপর তাকে পিছনে ফিরে আর তাকাতে হয়নি।
আওয়ামি লীগ সরকারের আমলে জড়িয়েছিলেন নানা অনিয়মে। নিজেকে জড়িয়েছিলেন আওয়ামীলীগের বিশ্বস্ত এক হাতিয়ার হিসেবে। ৫ আগষ্টের পরে সবকিছু পাল্টে গেলেও পাল্টেনি এসআই এনামুল। অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগষ্টের পরে তার চিরচেনা পুরনো কর্মস্থল দাউদকান্দিতে অবস্থান করে আওয়ামী লীগের পলাতক বহু নেতাকমীর সাথে তার এখনো যোগাযোগ রয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পদায়ন হওয়া দাউদকান্দি মডেল থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই হারুন দীর্ঘ দুই বছরের উপরে সময় অতিবাহিত করলেও তার বদলির কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে রয়েছে এক ধরণের চাপা ক্ষোভ। অভিযোগ রয়েছে ৫ আগষ্টের পর পলাতক আসামীদের সাথে রয়েছে তারও গোপন যোগাযোগ।
উল্লেখ যে, ওসি মোজাম্মেল যখন চট্টগ্রাম জেলার শীতাকুন্ড থানার তদন্ত ইন্সপেক্টে, তখন সে সময়ের চট্টগ্রাম জেলার এসপি ছিলেন নুরে আলম মিনা। সময়ের ব্যবধানে ২০২৩ সালে যখন নুরে আলম মিনা চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে যোগদান করেন তখনি ওসি মোজাম্মেল বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জে বদলি হয়ে বাগিয়ে নেন দাউদকান্দি মডেল থানার ওসির চেয়ারটি। এরপর ওসি মোজাম্মেল পুলিশ বাহিনীর আড়ালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে তুলেন অপরাধের সাম্রাজ্য। আর এই অপরাধ সাম্রাজ্যের সিন্ডিকেট বাহিনীতে ছিলেন থানার এসআই এনামুল, থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই হারুন ও থানাধীন গৌরিপুর পালিশ ফাঁড়ির এসআই সাইদুল ইসলাম অন্যতম। ৫ আগষ্টের পর অন্য সদস্যরা বদলি হলেও এই দুই ব্যক্তি এখনো রয়েছেন পুরনো কর্মস্থলেই। যা নিয়ে রহস্য যেন কিছুতেই থামছে না তাদেরকে নিয়ে।
৫ আগষ্টের আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানী, মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি, ঘুষ কেলেঙ্কারী, নিরিহ মানুষদেরকে মাদক দিয়ে হয়রানি ও জব্দকৃত মালামাল আত্মসাৎসহ নানান ধরণের গুরুতর অপকর্মে জড়িত থাকার বিষয়ে গত বছরের ১৩ জুন ও ২৪ জুন দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় থানা পুলিশের সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ফলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ২৪ জুন- ২৪ খিঃ, কুমিল্লার পুলিশ সুপারের ২৭ জুন- ২৪খিঃ ও ২৯জুন- ২৪ খিঃ তারিখে স্বারকের পেক্ষিতে সহকারী পুলিশ সুপার, দাউদকান্দি সার্কেলকে ৩০ জুন- ২০২৪ তারিখে পুলিশ সাদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিক অনুসন্ধানপূর্বক ২১ কার্য দিবসের মধ্যে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময় ২৪’র জুলাই-আগষ্টের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনার পেক্ষিতে সেই প্রতিবেদন আদৌ জমা দিতে পারেননি তদন্ত কর্তৃপক্ষ।

এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব বলে কি আপনি মনে করেন?