বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় লালমনিরহাট জেলা তার উর্বর মাটি এবং বৈচিত্র্যময় কৃষি উৎপাদনের জন্য পরিচিত। এ জেলার কৃষকদের মধ্যে আখ চাষ এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। আখ থেকে গুড়, চিনির মতো বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করা হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকার এ বছর থেকে দেশীয় চিনি কারখানা গুলো আবার উৎপাদন মুখী করার ফলে কৃষকরা আবার আখ চাষে লাভের আশ্বাস ফিরে পাচ্ছে।
রংপুর অঞ্চলে আখ চাষের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে হ্রাস লক্ষ্য করা গেছে। ২০২২ সালে রংপুর অঞ্চলে আখ চাষ হয়েছিল ৩৬,৫০০ হেক্টর জমিতে, যা এর আগের বছরগুলোতে ৫০ হাজারের বেশি হেক্টর জমিতে ছিল। সুগার মিল বন্ধ হওয়ার পর থেকে আখের চাষ ক্রমশ কমতে শুরু করেছে।
প্রতি হেক্টর জমি থেকে গড়ে ৫২ মেট্রিক টন আখ উৎপন্ন হয় এবং আখ থেকে ৪ মেট্রিক টন গুড় উৎপন্ন হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে আখ উৎপন্ন এবং আখ থেকে গুড় উৎপাদন করতে খরচ হয় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত।
আখ চাষ বাংলাদেশের কৃষি খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। দেশের খাদ্যশস্য এবং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আখ থেকে গুড়, চিনি এবং আখের রস উৎপাদিত হয়, যা দেশের মিষ্টান্ন এবং পানীয় শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এছাড়াও, আখের খড় পশুখাদ্য এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লালমনিরহাটে আখ চাষের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক উন্নতি ঘটে এবং স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।
লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাপকভাবে আখ চাষ করা হয়। বিশেষ করে হাতীবান্ধা, আদিতমারী এবং কালীগঞ্জ উপজেলায় আখ চাষের জন্য পরিচিত। আখ চাষের জন্য উর্বর মাটি এবং উপযুক্ত জলবায়ু লালমনিরহাটের কৃষকদের আখ চাষে উৎসাহিত করে। প্রতি বছর কৃষকেরা হাজার হাজার একর জমিতে আখ চাষ করেন এবং এ থেকে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন লাভ করেন।
আখ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় মাটি প্রস্তুতি, সঠিক সময়ে বীজ বপন, সঠিক সেচ এবং রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লালমনিরহাটে কৃষকেরা সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আখের বীজ বপন করেন এবং ১০-১২ মাস পর ফসল কাটা হয়। আখের বীজ বপনের পর প্রায় প্রতি সপ্তাহে সেচ দেওয়া হয় এবং সুষম সার এবং কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
আখের ফসল সংগ্রহের পর, সেগুলো স্থানীয় গুড় কারখানায় পাঠানো হয়, যেখানে গুড় এবং চিনি উৎপাদিত হয়। স্থানীয় কৃষকেরা গুড় এবং চিনি উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের আয় বাড়ায় এবং স্থানীয় বাজারে এ পণ্যগুলির সরবরাহ নিশ্চিত হয়। বাজারজাতকরণে চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে সঠিক সামঞ্জস্য না থাকলে কৃষকেরা ন্যায্য মূল্য পায় না।
লালমনিরহাটে আখ চাষের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নত কৃষি প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আখ চাষের পরিমাণ এবং গুণগত মান বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষকদের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি এবং নতুন বীজ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এ লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করা যায় । আখ সংরক্ষণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পচন কমানো সম্ভব। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুদাম এবং সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে আখের দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যায়। উন্নত বিপণন নেটওয়ার্ক এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে আখের বাজারজাতকরণ সহজ করা যেতে পারে। কৃষকদের জন্য সরাসরি বাজার সংযোগ তৈরি করে এবং বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের মুনাফা বৃদ্ধি করা যায়। সরকার এবং ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। এতে করে কৃষকরা আখ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে।
কৃষক আবেদ আলী (৭০) যিনি ময়মনসিংহ থেকে লালমনিরহাটে এসেছিলেন শোনা যায় তারাই অনেক আগে থেকেই আখ চাষ করে থাকে। আখ চাষ সম্পর্কে তার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘আমরা বংশীয়ভাবে এখানে আখ চাষ করে থাকি। আমরা আশাহত হই নাই। আমরা এখনো নিয়মিতভাবে আখ চাষ করি। ইদানিং শোনা যাচ্ছে সরকার চিনি মিল গুলো চালু করে দিবে তো এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।’
জেলা কৃষি উপ-পরিচালক ড. মোঃ সাইখুল আরিফিন আগাম আখ চাষ সম্পর্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা এবার আখ চাষে কৃষকদের বেশি উৎসাহ দিব। কারণ সরকার চিনি কল গুলো চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে ক্ষেত্রে সামনের মৌসুমে আখের একটি ব্যাপক চাহিদা লক্ষণীয়।’
আখ চাষ লালমনিরহাটের স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এই চাষাবাদ বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা স্থানীয় জনগণের জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। কৃষক, কাজের মানুষ এবং পরিবহন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত লোকজন সবাই এর থেকে উপকৃত হয়। এছাড়াও, আখ চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত গুড় এবং চিনি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়।