পৃথিবীকে পরিবেশবান্ধব এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গাছের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তাই বলে সব রকমের গাছই যে মানুষের জন্য উপকারী কিংবা পরিবেশবান্ধব হবে তা কিন্তু নয়, বরং হতে পারে এর উল্টোটাও। ইউক্যালিপটাস এমনই একটি গাছ, যা পরিবেশের ওপর বিভিন্ন বিরূপ প্রভাব ফেলে।
সারা বিশ্বে প্রায় ৭০০ প্রজাতির ইউক্যালিপটাস আছে। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে ডাকা হয় ইউক্যালিপটাস ওবলিকোয়া। অস্ট্রেলিয়া থেকে ৪৫ লাখ টন ইউক্যালিপটাস কাঠের ফালি আসবাবপত্রের কাজে রফতানি করা হয় যা থেকে বছরে প্রায় ২৫ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয়। এই গাছটি থেকে কিনো, তেল ও ট্যানিন পাওয়া যায়। এই গাছের তেল অ্যান্টিসেপটিক ও পরিষ্কারক হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং মশা নিধনেও ভূমিকা রাখে। এছাড়া ইউক্যালিপটাসের ফুল সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি মধু উৎপাদনেও সহায়ক।
তবে ইউক্যালিপটাস একটি গাছ যা মাটি থেকে অতিমাত্রায় পানি শোষণ করে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটায়। মাটির গুণাগুণের কারণে এটি বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বেশি রোপণ করা হচ্ছে। একটি ইউক্যালিপটাস গাছ তার আশপাশের প্রায় ১০ ফুট এলাকার ও ভূগর্ভের প্রায় ৫০ ফুট নিচের পানি শোষণ করে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়। ফলে দ্রুত মাটিতে পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং আশপাশের অন্যান্য প্রজাতির গাছ জন্মাতে পারে না। গাছটি মাটিকে শুষ্ক করে ফেলে এবং মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, গাছটি কেটে ফেললেও মাটির উর্বরতা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। এমনকি এ গাছের ফুল ও ফল ঝরে পড়লে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয়। ইউক্যালিপটাসের পাতায় এক ধরনের অ্যান্টিসেপটিক থাকায় এর নিচে ছোট গাছ বাড়তে পারে না এবং পোকামাকড়ও মারা যায়। এর ফুল ও পাপড়িগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের সৃষ্টি করতে পারে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত বিপদজ্জনক গাছ হলো ইউক্যালিপটাস।
বাংলাদেশে এক সময়ে সরকারি কর্মসূচির আওতায় ইউক্যালিপটাস রোপণ করা হয়েছিল, বিশেষ করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায়। তবে ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় এবং এরপর বনবিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করে। তারপরও, অনেক আগে সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে রোপিত ইউক্যালিপটাস গাছ এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান।
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ইউক্যালিপটাসের প্রভাবে সেসব এলাকার ফসল ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা মতে, ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি ও ইপিলইপিলের মতো বিদেশি দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির গাছ মাটির ৫০-৬০ ফুট নিচ পর্যন্ত পানি শোষণ করে তা বাতাসে ছেড়ে দেয়, ফলে মাটিতে পানিশূন্যতা ও উর্বরতার হ্রাস ঘটে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বনবিভাগকে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছ না লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “বন বিভাগ আর ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছ রোপণ করবে না।” জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বায়োডাইভারসিটি রুলস ও গাইডলাইন তৈরির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “লাঠি টিলা, চুনতি, সাতছড়ি ও লাউয়াছড়ার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে।”
হাতীবান্ধা উপজেলার সিংগীমারি ইউনিয়নের কৃষক ওহেদ আলী (৬৫) জানান, “আমার ১০০ শতক জমির আইল ব্যবহার করে পাশের জমির মালিক ইউক্যালিপটাস গাছ রোপন করেন। ফলে আমার জমিতে কোন ফসল হয় না। গেলোবার সরিষা চাষ করেছিলাম ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এইজন্য জমিটা কোন কাজে ব্যবহার করতে পারছি না এবং আমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ ব্যাপারে আমি কৃষি অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছি উনি আমাকে সাহায্যের জন্য আশ্বস্ত করেছেন।”
হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কার্তিক কুমার এ প্রসঙ্গে বলেন, ” একটি পরিপক্ক ইউক্যালিপটাস গাছ দিনে ২২ মন পানি গ্রহণ করে। এই গাছের পাতা কোন জমিতে পড়লে সে জমিতে কোন ফসল হয় না। যদি কোন ফসোলী জমির মাঝে এই গাছ থাকে, আর কৃষক যদি আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ জানান, সেক্ষেত্রে আমার সরজমিনে পরিদর্শন করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম।”
বাংলাদেশের পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা রক্ষার জন্য ইউক্যালিপটাস গাছের রোপণ সীমাবদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা ইউক্যালিপ্থানীয় বাজারে বিক্রি করে কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়।