মনিরুল ইসলাম, নাটোর প্রতিনিধিঃ
নাটোরে ভাতুরিয়া গ্রামে ঐতিহ্যবাহী গাঁওয়ালী সিরনী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার(৬ জানুয়ারি) সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের ভাতুরিয়া গ্রামে দিনব্যাপী প্রায় দুই শত বছরের পুরোনো এই উৎসব পালিত হয়। স্থানীয় বিএনপি নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় এই উৎসবে ২৬ টি সমাজের ৪৬০ টি পরিবারের প্রায় ১৭শ মানুষ অংশ নেন। এ উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নাটোর ২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু।
ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবে উপস্থিত বক্তব্যে দুলু বলেন, গত সরকারের সময় গ্রামীণ ঐতিহ্যের উৎসবগুলো হারিয়ে যেতে বসেছিল। আমরা সেই ঐতিহ্য ও পুরোনো কালচার সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনবো। নিজেদের মধ্যে দলাদলির কারনে ভাতুরিয়া গ্রামের বহুকালের ঐতিহ্যবাহী এসব উৎসব কয়েক বছর যাবত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, সমাজে সবাই সমানভাবে বাঁচতে পারবে। যার যার ধর্ম সমান ভাবে চিরাচরিত ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালন করতে পারবে। এসময় অন্যান্যের মধ্যে জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম বাচ্চু, সাবেক সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ, সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহীন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এই ঐতিহ্যবাহী সিরনী উৎসবকে ঘিরে দূর দূরান্ত থেকে জামাই – মেয়ে-নাতি-নাতনী সহ ও স্বজনরা এই ভাতুরিয়া গ্রামে আসেন। গাঁওয়াল সিরনীকে কেন্দ্র করে বিশাল ভোজনের আয়োজন করা হয়।
সোমবার ফজরের নামাজের পর থেকে দিনভর চলে এই আয়োজন। গ্রামবাসীরা জানান, পরিবারের সদস্য ও আগত আত্নীয় স্বজন ভেদে ৮ থেকে ১০ টি ভোজের ভাগ দেন পরিবার প্রধান। কেউ চাল আবার কেউ টাকা দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই সিরনী উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন প্রতিটি পরিবার। সবগুলো সমাজ ও পরিবারে দেয়া টাকা বা চাল উত্তোলন শেষ হলে একটি নির্ধারিত দিন ঠিক করে এই ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
উৎসবে অংশগ্রহনকারী সদস্য আব্দুস সালাম জানান, প্রতিটি গ্রামে একই সিরনীর ভাগ প্রতি ২শ থেকে ৫শ গ্রাম চাউল দিয়ে উৎসবে অংশ নেন গ্রামের মানুষ। দিঘাপতিয়া পিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম আনোয়ার জানান, প্রবীণদের থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রায় দু’শ বছর আগে থেকে অদ্যাবধি গ্রামবাসী বছরে দুইবার এ উৎসব পালন করে। প্রতি শীতকালে ঝাল এবং আষাঢ় মাসে মিস্টি সিরনী বানিয়ে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় ভাতৃত্বের বন্ধন। উৎসবে আগত আত্নীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে আনন্দ উপভোগ করা হয়। এই উৎসব ঘিরে বিভিন্ন পসরা খেলনা ও নানা রকম খাবারের দোকান মেলা বসছে। গাঁওয়ালী এই সিরনী উৎসব যেন গ্রামবাসীর কাছে ঈদ উৎসব। স্থানীয় ইউপি সদস্য নাসিম মাহমুদ বলেন, কথিত আছে, প্রায় ২শ বছর আগে এই গ্রামে ডায়রিয়া,কলেরা রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়। অনেক মানুষ মারা যায়।
পরে অতাব্দি ফকির নামে এক আলেম এই সিরনী করার পরামর্শ দেন। আলেমের দেয়া পরামর্শ পেয়ে গ্রামবাসীরা মিলে সিরনী উৎসব করেন। এতে গ্রামবাসীরা প্রাদুর্ভাব মুক্ত হয়ে সুস্থ্য হয়ে উঠেন। এর পর গ্রামের গবাদিপশু রোগে আক্রান্ত হলে একইভাবে খির সিরনীর আয়োজন করা হয়। এরপর গবাদিপশুর প্রাদুর্ভাব থেকেও রক্ষা পান গ্রামবাসী। এই দুটি ঘটনা থেকেই ভাতুরিয়া গ্রামবাসী প্রতিবছর গাঁওয়াল সিরনী উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
দিঘাপতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও দিঘাপতিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভাতুরিয়া গ্রামের দেখাদেখি এখন আশেপাশের গ্রামগুলোতেও এ উৎসবের অনুকরণ করা হচ্ছে। কিন্তু ২০০ বছরের এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গাঁওয়াল সিন্নি উৎসব একমাত্র ভাতুরিয়া গ্রামেই সূচনা হয়। ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবে অংশ নিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী নাটোরের জননেতা এ্যাড.এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তার আগমনে এই গাঁওয়াল সিরনী উৎসব একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়।