গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে ধীরে ধীরে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
প্রথমে ভারত বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার দোহাই দিয়ে ভিসা সীমিত করে দেয়। এরপর ভিসা নীতিতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে তা পুরোপুরি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য কোন দিকে যাচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক গত ৫৩ বছরের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এবার নতুন করে আলোচনায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। দুই দেশই নিচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। ফলে এসব পদক্ষেপ নিয়ে আবার দুই দেশই বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি দিচ্ছে।
সবশেষ নভেম্বরে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার, ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলার ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়।
এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয় কড়া পদক্ষেপ। কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনে ভারতীয়দের জন্য বাংলাদেশের ভিসা সীমিত করে বাংলাদেশ। গত ৫৩ বছরের ইতিহাসে দুই দেশের সম্পর্কের এমন টানাপোড়েন দেখছে বিশ্ব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশ সবচেয়ে বড় সীমান্ত প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশই আমদানি-রপ্তানি করে থাকে। এখানে সহজে ও স্বল্প সময়ে বাণিজ্য সম্পাদন হয়। ফলে দুই দেশের অর্থনীতির জন্যই তা ইতিবাচক।
কিন্তু সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যেই যে সম্পর্কের টানাপোড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে, এতে দুই দেশই সমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ ভারত থেকে বড় পরিমাণে আমদানি করে থাকে। তাই এখানে ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। এ ছাড়া প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যান বেশ বড়সংখ্যক মানুষ।
এটা ভারতের ট্যুরিজম খাতেও ইতিবাচক প্রভাব রাখে। এখন যেহেতু্ এই মানুষগুলো যেতে পারছে না, তাহলে তা ভারতের অর্থনীতিতেও চাপ সৃষ্টি করবে।
ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের কী অবস্থা : ভারত থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় তুলো ও সুতো। এসব আমদানিকৃত তুলো ও সুতো ব্যবহৃত হয় তৈরি পোশাক শিল্পে। বাংলাদেশের চাহিদার বেশিরভাগ তুলো ও সুতো আমদানি করা হয় ভারত থেকে। বাংলাদেশ যত তুলো ও সুতো আমদানি করে এর ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই করে ভারত থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ যত সু্তো আমদানি করেছে তার মধ্যে ভারত থেকেই ৮৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আর চলতি বছরের জুলাইয়ে চাহিদার ৮৭ শতাংশ সুতো ভারত থেকে আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
খাদ্যপণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মরিচ, ফসলের বীজসহ কৃষিপণ্য আমদানি করা হয় ভারত থেকে। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছে সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি হয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ টন পণ্য। এসব পণ্যের মূল্য ছিল ২৯ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে মাসে গড়ে আসছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার পণ্য।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে জুলাইয়ে। বাংলাদেশ থেকে চলতি বছরের জুলাইয়ে রপ্তানি হয়েছে ১৬ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের পণ্য, যেখানে আগের বছরের জুলাইয়ে রপ্তানি করা হয়েছিল ১৫ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি বছরের জুলাইয়ে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ।
হিলি স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বলেন, হঠাৎ করে আলু আমদানি বন্ধের কারণে এলসিকৃত আলু আমদানি না হলে ক্ষতির মুখে পড়বেন বন্দরের ব্যবসায়ীরা। আমরা আলু আমদানির জন্য প্রচুর পরিমাণ এলসি করে রেখেছি। আলু আমদানি না হলে এলসি করা টাকা, বুকিংকৃত টাকা নিয়ে আমরা টেনশনে আছি।
এ সংকট কেটে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্প, আমদানি শিল্প এবং ভোক্তা কল্যাণের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য এসবের অনেকগুলোই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং সেটা আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমার মনে হয়।
তিনি বলেন, সমস্যা আমাদের দিক থেকে না। আমরা ভারতের বিপক্ষে যাইনি। ভারত আমাদের পরিবর্তনটা গ্রহণ করতে পারছে না বলেই সমস্যটা তৈরি হয়েছে। আশা করি, ভারত আমাদের পরিবর্তনটা মেনে নেবে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের উসকানিমূলক কাজ করা থেকে বিরত থাকবে। তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে।